সাইফ উল্লাহ, সুনামগঞ্জ থেকে: সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা ও মধ্যনগর হাওররক্ষা বাঁধের কাজে এখনও গঠন করা হয়নি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি)। বাঁধের কাজ শুরুর নির্ধারিত সময় সীমার তিন মাস পেরিয়ে গেলে শুধু নাম মাত্র কয়েকটি বাঁধের কাজ শুরু করা হয়েছে । অচিরেই সম্পন্ন হবে এমন কোন আলামতও চোখে পড়ছে না।
এ নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন কৃষকরা। হাওররক্ষা বাঁধের কাজ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টালবাহানা হাওরপাড়ের কৃষকসহ সচেতন মানুষের মাঝে চরম অসন্তোষ ও শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। কৃষক রমিজ উদ্দিন জানান, কোন প্রকার তকদির ছাড়া কাজ পাওয়া যায়না, তাই মহোদয় গণ দেরীতে কাজ দিচ্ছেন, ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ধীর গতি, এর কারণ কি?
হাওররক্ষা বাঁধের কাজের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠন নীতিমালা অনুযায়ী বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের জন্য ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সকল পিআইসি কমিটি চূড়ান্ত করে কাজ শুরু কথা গেল বছরের ১৫ ডিসেম্বর। আর ১৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাঁধের কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে দেখা গেছে তার উল্টো চিত্র। ধর্মপাশা ও মধ্যনগর উপজেলায় শুধু নাম মাত্র কয়েকটি বাঁধের কাজ শুরু করা হয়েছে । প্রতি বছরের মত এবারও ধর্মপাশা ও মধ্যনগর উপজেলায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পিআইসি গঠন করে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ শুরুও হয়নি। শুধু মাত্র কয়েকটি বাঁধে উদ্বোধন করেই শুরু হয়েছে এমনটা জানান দিচ্ছে পাউবো।
এদিকে সঠিক সময়ে কাজ শুরু না হওয়ায় পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে বোরো ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন হাওরাঞ্চলের হাজার হাজার কৃষক। তারা অভিযোগ করে বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ বাঁধের কাজে ঢিলেমি লক্ষ্য করা গেছে। তাই এক ফসলি বোরো ফসলি জমির ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ কৃষকদের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
সুনামগঞ্জ পাউবো সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জে জেলার ধর্মপাশা ও মধ্যনগর উপজেলার ৯ টি হাওড়ে এবার ২২৫ কিলোমিটারে ফসল রক্ষা বাঁধ মেরামত ও নির্মাণ হবে। ১৬৫টি প্রকল্প নির্ধারণ করা হয়েছে।
এসব প্রকল্পে প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ৩৪কোটি ৭ লাখ টাকা। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে পিআইসি গঠন করা হয়েছে ১৬৫ টি। এ পর্যন্ত কাজ শুরু হয়েছে ১৩ টি প্রকল্পে। বাকি ১৫২টি প্রকল্পে এখনো কাজ শুরু হয়নি। এদিকে হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতারা। তারা বলছেন, হাওর থেকে দেরিতে পানি না নামার দোহাই দিয়ে কাজ পিছিয়ে পড়েছে বলে জানাচ্ছে পাউবো। কিন্তু এ যুক্তি আদতে সঠিক নয়। পাউবো বরাবরই নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু করে না। ফলে এ নিয়ে লাখ লাখ কৃষক উৎবেগ, উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কের মধ্যে সময় পার করছে। এবার হাওরের কোন ক্ষতি হলে এর দায়ভার পাউবোকেই নিতে হবে।
তারা আরও জানিয়েছেন, ২০১৭ সালের প্রলয়ঙ্করী হাওর বিপর্যয়ের পর টানা তিন বছর প্রকৃতি অনুকূলে ছিল। দুই/তিন বছর পর পর হাওরে চরম বিপর্যয় নেমে আসে। হাওরপাড়ের মানুষ বার বার এমনটাই দেখে আসছেন। সেদিক থেকে এ বছর প্রকৃতি প্রতিকূলে থাকার সম্ভাবনাই বেশি। সব মিলিয়ে কৃষকের চিন্তার শেষ নেই। এর মাঝে সময়মতো বাঁধের কাজ শুরু না হওয়াটা আরও বেশি ঝুঁকির জানিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন হাওরপাড়ের অগণিত মানুষ।
সুখাইড় রাজাপুর ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল হাই বলেন, ‘হাওরে এখনও বাঁধের কাজের খবর নাই। তাড়াতাড়ি কাজ শুরু না হইলে চৈত্র মাসে গোলা (পানি) আইসা হাওর তলাইয়া যাইব। এর লাগি আমরা খুব চিন্তিত। ফসল ফলাইয়া তা পানিত ডুইব্বা গেলে এই কষ্ট কে দেখব?’
চামরদানী ইউনিয়নের চামরদানী গ্রামের কৃষক মো. রফিকুল মিয়া বলেন, ‘সময়মতো কাজ না হইলে কৃষকের কষ্ট সব বিফলে যাইব। এখনই কাজ করার সময়। কিন্তু পিআইসিই গঠন হইছে না, তা হইলে কাজ শুরু হইব কোনদিন? কোনদিন কাজ হইব, আর কোনদিন শেষ হইব- এইডা হেরাই কইতে পারব। কৃষকের কপালে দুর্দশা নাইম্যা আইলে কাজ কইরা কিতা হইব?’
গুরাডুবা হাওরপাড়ের কৃষক সিরাজ মিয়া বলেন, ‘হাওররক্ষা বাঁধের কাজ সময়মতো শুরু না হওয়াটা আসলেই উদ্বেগজনক। এমনিতেই কৃষকের ভাগ্য সারাক্ষণ অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে। এর মাঝে যদি সময়মতো কাজ শুরু না হয়, তাহলে অনিশ্চয়তা আরও বেড়ে যায়। পানি এসে হাওর যদি ডুবেই যায়, তাহলে কাজ করে লাভ কী?’
উপজেলা হাওর বাঁচাও আন্দোলনের আহবায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা সুলতান তালুকদার বলেন, ‘হাওররক্ষা বাঁধ দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য আমরা মানববন্ধন করেছি। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও , কিন্তু কাজ শুরুর খবর নেই। বন্যার কারণে এমনিতেই ক্ষেত লাগানো পিছিয়ে পড়েছে। এর মধ্যে অকাল বন্যা দেখা দিতে পারে। যদি ২০১৭ সালের মতো পাহাড়ি ঢল নেমে আসে তখন হাওর রক্ষা করবে কে?’
সুনামগঞ্জ জেলার পাউবোর সহকারী প্রকৌশলী ও ধর্মপাশা ও মধ্যনগর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব জাহাঙ্গীর আলম সানোয়ার আহমেদ বলেন, আমাদের জরিপ কাজ শেষ হয়েছে। হাওরের পানি সময়মতো না কমায় প্রকল্পগুলো অনুমোদন দিতে একটু সময় লেগেছে।
আগামী এক সাপ্তার মধ্যে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হবে।
এ বিষয়ে ধর্মপাশা উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি মো. অলিদুজ্জামান, মধ্যনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নাহিদ হাসান খান বলেন, এখনো হাওড়ের পনি না নামায় প্রকল্প অনুমোদন দিতে বিলম্বত হয়েছে। তবে আগামী এক সাপ্তার মধ্যে প্রকল্পের কাজ পিআইসিদের কাছে ভুঝিয়ে দেওয়া হবে।
বিপি>আর এল