রমজান আলী টুটুল,সৈয়দপুর (নীলফামারী) প্রতিনিধি: নীলফামারীর সৈয়দপুরে খুরারোগের মহামারী শুরু হয়েছে। প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে আক্রান্ত গরু। এ পর্যন্ত অর্ধ শতাধিক গরু মারা গেছে এবং কয়েকশ’ আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশই সরকারী ভ্যাকসিনকৃত। ভ্যাকসিন দেয়ার পরও ব্যাপকভাবে পশু অসুস্থ হওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন খামারীরা। অনেকে শেষ সম্বল হারিয়ে পথে বসেছেন।
পশু মালিকদের অভিযোগ সরকারী ভ্যাকসিন দেয়ার ক্ষেত্রে ত্রুটির কারণে এই ক্ষতির মুখে পড়েছে লাইভস্টক খাত। পরিস্থিতি খারাপ হয়ে পড়লেও উপজেলা পশুসম্পদ অফিস অসহযোগিতা করায় ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কি কারণে এত দ্রুত এমন নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা বুঝে উঠতে পারছেন না কর্তৃপক্ষ। উচ্চ পর্যায়ের গবেষক টিম পরিদর্শন করলেও কোন সুরাহা বের করতে না পারায় অবস্থা জটিল হয়ে পড়েছে।
জানা যায়, চলতি মাসের প্রথম দিকেই সৈয়দপুর পৌরসভার বিভিন্ন এলাকাসহ উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নেই খুরারোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এক সপ্তাহের মধ্যে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকেই শুরু হয় পশুর মৃত্যু। এ পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশটি গরু মারা গেছে। আক্রান্ত প্রায় তিন শতাধিক। প্রতিদিনই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে চলেছে বলে বিভিন্ন এলাকার মাধ্যমে জানা যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে ভ্যাকসিন না দেয়া পশুর চেয়ে সরকারী ভ্যাকসিনকৃতই বেশি।
সবচেয়ে বেশি গরু মারা গেছে খাতামধুপুর ইউনিয়নের মুশরত ধুলিয়া টেপাদহ ডাক্তার পাড়ায়। এখানকার হাশেম আলী বাবু বলেন, এই পাড়ায় ৬ টি খামার আছে। এর মধ্যে ৪ টি খামারের প্রায় ৫০ টি গরু আক্রান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে আমার একটিসহ ১৩ টি মারা গেছে। এর মধ্যে ৬ টি ৮ মাসের গাভিন, ৪ টি দুধেল ও ৩ টি বাছুর। আরও যে কয়টা মরবে তা নিয়ে আতঙ্কে আছি। উন্নত জাতের দামী গরুগুলো মারা যাওয়ায় আমরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।
এমামুল হক বলেন, আমি ঋণ নিয়ে খামার করেছি। আমার ১০ টি গরুই আক্রান্ত হয় এবং ৩ টি গাভিন ও ২ টি বাছুর মারা গেছে। পূঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। এখন কিভাবে ঋণ শোধ ও সংসার চালাবো? এর আগে ব্র্যাক চিলিং সেন্টারের ভ্যাকসিন দিয়েছি। তাতে কখনোই এমন হয়নি। এবার সরকারী ভ্যাকসিন দেয়ায় এই সর্বনাশ হয়েছে।
তিনি বলেন, আমার ছোট ভাই ব্র্যাকের ভ্যাকসিন দিয়েছে। তার ২০ টি গরুর একটাও আক্রান্ত হয়নি। অথচ তার খামারেই আমার একটা বাছুর ছিলো। সেটাও মারা গেছে। মূলত: সরকারী ভ্যাকসিনে কোন সমস্যা ছিলো বা দেয়ার ক্ষেত্রে ত্রুটি হয়েছে। তাই আজ আমরা ক্ষতির শিকার হয়েছি। এর দায় কে নিবে?
আব্দুল আজিজ বলেন, আমরা ইউনিয়নে সরকারীভাবে গঠিত খামারী ক্লাবের সদস্য।দুই মাস আগে আমি বেলা ১১ টায় উপজেলা পশু হাসপাতালে খুরারোগের ভ্যাকসিনের জন্য মোবাইলে জগন্নাথ দাদাকে কল করি। তিনি জানান দুপুরে দেয়া যাবেনা। সকালে বা রাতে দিতে হবে। তাই বিকেল ৫ টায় আমাদের পাড়ায় আসবেন।
এই কথা পাড়ার সবাইকে জানিয়ে আমি বাইরে কাজে যাই। কিন্তু দুপুর ১২ টার দিকে ইউনিয়ন সুপারভাইজার হাবিব এসে ভ্যাকসিন দিয়ে যায়। সে ভ্যাকসিন প্রদানে পরিবেশ ও সময়ের ত্রুটি করেছে অথবা সঠিকভাবে পরিমাণমত (ডোজ) ভ্যাকসিন দেয়নি। আর নয়তো প্রকৃত ভ্যাকসিনই দেয়নি। তা না হলে এই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে কেন? আমাদের এই ক্ষতির জন্য সেই দায়ী।
এদিকে জামাল উদ্দিন বলেন, নভেম্বরের ১ তারিখের দিকে রোগ দেখা দেয়া মাত্রই ভ্যাকসিন প্রদানকারী হাবিব কে জানালেও সে কোন ভ্রুক্ষেপ করেনি। বাধ্য হয়ে সৈয়দপুর পশু হাসপাতালে জানাই। তারাও প্রথম দিকে সাড়া দেয়নি। নিরুপায় হয়ে পার্শবর্তী রংপুর জেলার তারাগঞ্জ উপজেলার পশু হাসপাতালের ভিএস ডা. আব্দুল করিমের চিকিৎসা নেই। ততক্ষণে দেরী হয়ে যাওয়ায় এতগুলো গরু মারা গেছে।
খামারীদের অভিযোগের ভিত্তিতে সুপারভাইজার হাবিবের সাথে মুঠোফোনে কথা বললে তিনি বলেন, আমি বিকালে ভ্যাকসিন দিয়েছি। কোন ত্রুটি হয়নি। অন্য কোন কারণে সমস্যা হয়েছে। অসুস্থ হওয়ার পর খবর পেয়েও কেন যাননি প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, অফিসের লোকজন সহ যেতে চেয়েছি। তারা সময় না পাওয়ায় যাওয়া হয়নি।
সৈয়দপুর উপজেলা পশুসম্পদ কর্মকর্তা শ্যামল কুমার রায় বলেন, গত ১১ তারিখে আমি গিয়ে দেখি তারা তারাগঞ্জ উপজেলার পশু হাসপাতালের ভিএস কে দিয়ে ট্রিটমেন্ট করছেন। তাই আর কোন চিকিৎসা দেইনি। তবে পরিস্থিতি ভয়াবহ এবং দ্রুত মৃত্যুর কারণ বুঝে উঠতে না পারায় উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখি। এতে গত ১৫ নভেম্বর ঢাকা থেকে উচ্চ পর্যায়ের গবেষক টিম এসে পরিদর্শন করেছে।
তিনি বলেন, আমাদের কোন অবহেলা নেই। ভ্যাকসিন দেয়ার ক্ষেত্রেও ত্রুটি হয়নি। আবহাওয়া ঠাণ্ডা থাকলে দুপুরেও দেয়া যায়। খুরারোগে মূলত: পশুর মুখে ও পায়ের খুরে ঘা হয়। গায়ে জ্বর থাকে এবং লালা পড়ে। পশু খেতে পারেনা তাই পানিস্বল্পতায় দূর্বল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে হার্টে ক্ষত সৃষ্টি হওয়ায় মারা যায়। কিন্তু এবার অল্প সময়েই মৃত্যু ঘটছে। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। কিন্তু খামারীরাই সহযোগিতা করছেন না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের ভ্যাকসিনের কোন সমস্যা আছে কি না তা গবেষকরাই বলতে পারবে। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে একই ভ্যাকসিন চলছে। এটার উন্নয়ন করা প্রয়োজন হতে পারে। হয়তো ভাইরাসের নতুন কোন ভেরিয়েন্ট ডিভলপ করেছে। তাই ভ্যাকসিন দেয়ার পরও মাত্র দুই মাসের মধ্যে পশু আক্রান্ত হয়েছে এবং দ্রুত মৃত্যু মুখে পতিত হচ্ছে। অথচ ভ্যাকসিন ৬ মাস মেয়াদী। আমরা যে নমুনা পাঠিয়েছি সেগুলো পরীক্ষার পরই প্রকৃত কারণ জানা যাবে।
বিপি/কেজে