গাইবান্ধা প্রতিনিধি: মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সুন্দরগঞ্জ থানার ওসি ও তৎকালীন গাইবান্ধা ডিবি পুলিশের ওসি মো. তৌহিদুজ্জামানের ফোনালাপ ফাঁসের তদন্ত ও পুনরায় তদন্ত করে নতুন অভিযোগপত্র প্রদানের দাবিতে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শনিবার (১৯ মার্চ) দুপুরে গাইবান্ধা শহরের গানাসাস মিলনায়তনে এই সভার আয়োজন করে হাসান হত্যার প্রতিবাদ মঞ্চ। দুপুর ১২টা থেকে প্রায় দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত এই সভা চলে।
মঞ্চের সমন্বয়ক আমিনুল ইসলাম গোলাপ এতে সভাপতিত্ব করেন।
সঞ্চালনা করেন সাম্যবাদী আন্দোলনের সদস্য সচিব মনজুর আলম মিঠু। সভায় বক্তব্য রাখেন জেলা গণফোরামের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মইনুল ইসলাম রাজা, জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা শেখ সামাদ আজাদ, জেলা জাসদের সভাপতি গোলাম মারুফ মনা, গাইবান্ধা পাবলিক লাইব্রেরী অ্যান্ড ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল হক জনি, জেলা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি মকছুদার রহমান শাহান, জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বাবু, জেলা সিপিবির সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান মুকুল, জেলা বাসদের আহবায়ক গোলাম রব্বানী, জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সদস্য মাসুদুর রহমান মাসুদ, ওয়ার্কার্স পার্টির (মার্কসবাদী) নেতা মিনাল কান্তি বর্মন, জেলা শ্রমিক জোটের সদস্য সচিব নুর মোহাম্মদ বাবু আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদ সদর উপজেলা শাখার আহবায়ক গোলাম রব্বানী মুসা, জেলা জাসদ ছাত্রলীগের সভাপতি রোকনুদ্দৌলা রোকন, সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ কবীর রানা, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আমিনুল ইসলাম, জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ওয়ারেছ আলী প্রধান, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের নেতা শামীম আরা মিনা প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, ব্যবসায়ী হাসান আলী হত্যা মামলার আসামীদের উদ্ধার করার চেষ্টা করেছেন তাদের স্বজনরা। ফলে তারা পুলিশকে ম্যানেজড করার চেষ্টা করেছেন। সম্প্রতি আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্রে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), পরিদর্শক (তদন্ত) ও একজন উপপরিদর্শক (এসআই) জড়িত থাকার সংশ্লিষ্টতা উল্লেখ করা হয়নি। অথচ হাসান আলী হত্যায় সবচেয়ে দায়ী পুলিশ প্রশাসন। এজন্য অভিযোগপত্রটি হালকা করা হয়েছে। এটা ম্যানেজড ও প্রভাবিত অভিযোগপত্র।
একই তদন্তকারী কর্মকর্তা দুই বার দুই রকমের অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন। এটা চরম আপত্তিজনক ও আইনের লঙ্ঘন। এতে ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। তারা আরও বলেন, সম্প্রতি তদন্তকারী কর্মকর্তার সাথে আসামীর স্বজনের যে ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে তা তদন্ত করতে হবে। তাকে প্রত্যাহার করা হলেও ওসি বিভিন্ন চক্রান্ত করছেন। ওসির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একটি মহল বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে।
ওসি তৌহিদুজ্জামান আসামী রুমেন হককে বাদ দিয়ে চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি প্রথম অভিযোগপত্র দেন। তারপর সংশোধিত অভিযোগপত্রে তাকে অন্তর্ভুক্তও করেন। এতেই বুঝতে পারা যায় ওসি আসামীর স্বজনদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। পুনরায় তদন্ত না করলে এই অভিযোগপত্রে ন্যায় বিচার সম্ভব নয়। আর তাই পুনরায় তদন্ত করে নতুন অভিযোগপত্র প্রদানসহ আসামীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান বক্তারা। সভা থেকে আগামী ১০ এপ্রিল হাসান হত্যার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে মানববন্ধনের ঘোষনা দেওয়া হয়।
সেই সাথে ওসি তৌহিদুজ্জামানের ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনায় সাহসিকতার সাথে সংবাদ প্রকাশ করায় খোলা কাগজ, দেশ রূপান্তর, ঢাকা মেইল, প্রথম আলো, চ্যানেল আই, চ্যানেল টোয়েন্টি ফোর, ও আরটিভি অনলাইনকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ প্রস্তাব সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নারাজী আবেদন দিতে বাদীকে অনুরোধ করা হবে। মামলার বিবরণে বলা হয়, গত বছরের ১০ এপ্রিল। ওইদিন সকালে গাইবান্ধায় আওয়ামী লীগ নেতার মাসুদ রানার (৪২) বাসা থেকে হাসানের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গাইবান্ধা সদর উপজেলার নারায়নপুর এলাকার মাসুদের বাসা। তিনি গাইবান্ধা জেলা আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদক। ঘটনার পর দল থেকে তাঁকে বহিস্কার করা হয়। মাসুদ রানা একজন দাদন ব্যবসায়ী।
দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে দাদন ব্যবসা করতেন। প্রায় দুই বছর আগে রানার কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নেন শহরের স্টেশন রোডের জুতা ব্যবসায়ী হাসান আলী। এই টাকা সুদাসলে ১৯ লাখে দাঁড়ায়। সুদের টাকা দিতে না পারায় গত বছরের ৬ মার্চ লালমনিরহাট থেকে হাসানকে মোটরসাইকেলে তুলে আসেন মাসুদ রানা। তিনি হাসানকে নিজ বাসায় একমাসের বেশি আটকে রেখেছিলেন। এনিয়ে নিহতের স্ত্রী বিথী বেগম সদর থানায় মাসুদ রানাসহ তিনজনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
অপর দুইজন হচ্ছেন শহরের স্টেশন রোডের জুতা ব্যবসায়ী রুমেল হক ও খলিলুর রহমান। প্রথমে মামলার তদন্ত করেন গাইবান্ধা সদর থানার তৎকালীন পরিদর্শক (অপারেশন) সেরাজুল ইসলাম। পরে গাইবান্ধা ডিবি পুলিশের তৎকালীন ওসি ও বর্তমানে সুন্দরগঞ্জের কঞ্চিবাড়ি তদন্ত কেন্দ্রের উপ-পরিদর্শক মানষ রঞ্জন দাস দায়িত্ব পান। সর্বশেষ মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তার দায়িত্ব পান গাইবান্ধা ডিবি পুলিশের ওসি মো. তৌহিদুজ্জামান।
এদিকে ঘটনার বিচারের দাবিতে ব্যবসায়ী ‘হাসান হত্যার প্রতিবাদ মঞ্চ’ গড়ে উঠে। বিচারের দাবিতে দুই মাসব্যাপী আন্দোলন চলে। আন্দোলনের মুখে সদর থানার তৎকালীন ওসি মাহফুজার রহমান, পরিদর্শক (তদন্ত) মজিবর রহমান এবং উপ-পরিদর্শক মোশারফ হোসেনকে অন্যত্র বদলি করা হয়। ঘটনার দিনই মাসুদ রানাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি বর্তমানে জেলা কারাগারে রয়েছেন।
এদিকে একই ঘটনায় হাসান হত্যার প্রতিবাদ মঞ্চের সমন্বয়ক আমিনুল ইসলাম বাদী হয়ে আদালতে আরেকটি মামলা দায়ের করেন। গতবছরের ৭ নভেম্বর গাইবান্ধা সদর আমলী আদালতে এই মামলা দায়ের হয়।
এই মামলায় মাসুদ রানা ও তিন পুলিশ কর্মকর্তাসহ ছয়জনকে আসামি করা হয়। বাদী পক্ষের আইনজীবি মো. নওসাদুজ্জামান বলেন, একই ঘটনায় সদর থানায় করা মামলার প্রতিবেদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে এই মামলার কার্যক্রম শুরু হবে। তাই আদালত মামলাটি মুলতবি (স্টে করা) করেন। সর্বশেষ অবস্থা : ঘটনার নয়মাস ছয়দিন পর মাসুদ ও খলিলুরসহ দুইজনের বিরুদ্ধে চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা মো. তৌহিদুজ্জামান আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
১৮ জানুয়ারি তিনি সুন্দরগঞ্জের ওসি হিসেবে বদলি হন। গাইবান্ধা কোর্ট পুলিশ ফেব্রæয়ারির শেষের দিকে অভিযোগপত্রটি সংশোধনের জন্য তদন্তকারি কর্মকর্তার কাছে ফেরত পাঠায়। গত ৭ মার্চ মাসুদ রানাসহ তিন আসামিকেই অভিযুক্ত করে আদালতে সংশোধিত অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়।
বিপি/কেজে