ছাবেদ সাথী
সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে চিকিৎসা করেছেন, ইউক্রেনের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন মেডগ্লোবালের প্রেসিডেন্ট ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা ড. জাহের সাহলুল। তিনি ভেবেছিলেন মানবতার সবচেয়ে অন্ধকার দিকগুলো তিনি দেখে ফেলেছেন। কিন্তু গাজায় গিয়ে তিনি বুঝলেন, মানবতা ধ্বংসের কোনো সীমা নেই।
ইসরায়েলি অবরোধে গাজায় মানবিক বিপর্যয় চরমে পৌঁছেছে। ৭০ হাজার শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে, হাসপাতালগুলো অচল, ওষুধ ও জ্বালানির অভাবে জরুরি চিকিৎসা বন্ধ। আমাদের এনজিও-র ত্রাণ মজুত দুই সপ্তাহের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
গত চার বছরে তিনি চারবার গাজা সফর করেছেন, তার নেতৃত্বাধীন চিকিৎসা সহায়তা সংস্থার কাজের অংশ হিসেবে। গাজার হাসপাতালে তিনি একজন সংকটজনিত রোগবিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন।
গত বছর নাসের হাসপাতালে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন যখন একটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর আহতদের ঢল নামে তাদের অনেকেই শিশু। পর্যাপ্ত বিছানা ছিল না। ওষুধপত্র প্রায় শেষ। চিকিৎসকদের এক হাতে বাঁধা অবস্থায় যুদ্ধক্ষেত্রের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়েছে।
তিনি শিশুদের বুক ছিঁড়ে টিউব বসিয়েছেন—স্থানীয় অ্যানেসথেশিয়া ছাড়াই। কারণ ওটুকুও তখন আর হাতে ছিল না।
আমেরিকায় কোনো অভিভাবক এমন চিকিৎসা মানতে পারতেন না। কিন্তু গাজায় এখন এটুকুই পাওয়া যায়। এবং এখন এমন পরিস্থিতিও হারিয়ে যেতে বসেছে।
গত দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েল গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। যদিও গত সপ্তাহে সামান্য কিছু ট্রাক প্রবেশ করেছে, তবু ত্রাণের মূল অংশ এখনো সীমান্তে আটকে আছে।
সম্পূর্ণ মানবিক সহায়তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মুখে। ৭০ হাজারের বেশি শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, ফেব্রুয়ারি থেকে মে—এই অবরোধের সময়ে অপুষ্টির হার ১৫০ শতাংশ বেড়েছে। তাদের সংগঠন দুই সপ্তাহের মধ্যে পুষ্টি সহায়তা সরবরাহে অক্ষম হয়ে পড়বে।
এই পরিস্থিতির মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল একটি নতুন সহায়তা পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছে। পরিকল্পনাটি অনুযায়ী কয়েকটি কেন্দ্রীয় বিতরণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে, যেগুলোর নিরাপত্তা দেবে বেসরকারি ঠিকাদার ও ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। আগে যেখানে চার শতাধিক বিতরণ পয়েন্ট ছিল, তা কমিয়ে চার-পাঁচটিতে নামিয়ে আনা হবে।
এটি কোনো মানবিক সহায়তা ব্যবস্থা নয়—এটি একটি অচল সিস্টেম। এটি এক ধরনের বারুদের স্তূপ, কারণ সীমিত সম্পদকে সামরিক পাহারায় কেন্দ্রীভূত করলে উত্তেজনা প্রশমিত হয় না, বরং আরও বেড়ে যায়।
মানবিক কাজের সাফল্য নির্ভর করে সেবাপ্রাপ্তদের আস্থার ওপর। সেখানে যখন সৈনিক বা বেসরকারি নিরাপত্তা বাহিনী জড়িত হয়, তখন সহায়তা কর্মীদের আর নিরপেক্ষ মনে করা হয় না—তারা সংঘাতের একপক্ষ হিসেবে দেখা দেয় এবং লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেছেন। তিনি জানেন, যখন সহায়তা অস্ত্রায়নে পরিণত হয়, তখন খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র বা হাসপাতাল পরিণত হয় মৃত্যুকূপে। গাজার প্রতি পাঁচজন মানুষের একজন এখন দুর্ভিক্ষের মুখে। ভাবুন, হাজার হাজার অসহায় মানুষ একটি সশস্ত্র খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রে ভিড় করছে।
সম্প্রতি ‘আটা গণহত্যা’ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি—যখন ইসরায়েলি বাহিনী একটি ত্রাণ কনভয় ঘিরে থাকা ক্ষুধার্ত মানুষদের ওপর গুলি চালায়। এটাই ঘটে যখন সহায়তা অপ্রতুল, মানুষ নিরাশ, আর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন। গাজায় দরকার একটি ত্রাণের প্রবাহ অতি দ্রুতগতিতে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঠিকই বলেছেন গাজায় আরও সহায়তা প্রবেশ করতে হবে। লক্ষ্য ঠিক অবিলম্বে মানুষকে সহায়তা পৌঁছে দিতে হবে।
কিন্তু পদ্ধতিটাও জরুরি। আমাদের এমন একটি কার্যকর পরিকল্পনা দরকার যা বাস্তব পরিস্থিতিতে কাজ করে। ট্রাম্প প্রশাসন যেন বাইডেন প্রশাসনের ভুল না করে—যেখানে ২০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে গাজার উপকূলে একটি ভাসমান পিয়ার বানানো হয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল সহায়তা প্রবেশ সহজ করা। কিন্তু সেই পিয়ার ভেঙে পড়েছে, ফেলে রাখা হয়েছে, এক সেনার জীবন গেছে, আর সহায়তা এসেছে সামান্যই—তাও বিশৃঙ্খলভাবে।
এই ব্যর্থতা অবাক করার কিছু নয়—মানবিক সহায়তা বিশেষজ্ঞরা আগেই সতর্ক করেছিলেন। এটি সেই ঘাটতি প্রকাশ করে—রাজনৈতিক ঢাকঢোল ও কার্যকর মানবিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে। নতুন পরিকল্পনাটিও একইভাবে বাস্তবতাবর্জিত।
একজন অপুষ্ট মা কীভাবে ৪০ পাউন্ডের খাদ্যপ্যাক বহন করে কয়েক মাইল দূরে পরিবারের কাছে নিয়ে যাবেন? বয়স্ক, প্রতিবন্ধী এবং গাজায় নতুন ৪,০০০ পঙ্গু মানুষ কীভাবে সহায়তা পাবে?
আর সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কথা কী হবে? খাদ্যপ্যাক ছাড়াও সহায়তা মানে জরুরি অস্ত্রোপচার, নিরাপদ প্রসব, অপুষ্ট শিশুদের চিকিৎসা। এর জন্য দরকার হাসপাতাল, জেনারেটরের জন্য জ্বালানি, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধ ও নিরাপদে হাসপাতালে পৌঁছানোর সুযোগ—এই সবই পরিকল্পনার বাইরে।
এসব শুধু সামান্য সমস্যা নয়—এই পরিকল্পনার ঘাটতিই প্রাণঘাতী।
অথচ কার্যকর ও পরীক্ষিত একটি সমাধান ইতোমধ্যেই আছে: জাতিসংঘ ও এনজিওগুলোর শত শত ত্রাণবাহী ট্রাক গাজার সীমান্তে অপেক্ষা করছে—খাদ্য, পানি ও ওষুধে ভর্তি, অর্থও পরিশোধিত। শুধু ইসরায়েল যদি অবরোধ তুলে নেয়, এ গাড়িগুলো আজই প্রবেশ করতে পারে।
বাস্তব সমাধান একটাই: যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জোর দিয়ে ইসরায়েলের ওপর চাপ দিতে হবে—মানবাধিকার আইনের আলোকে পুরনো ত্রাণপ্রবাহ ফের চালুর জন্য। দরকার কার্যকর মানবিক করিডোর—প্রতিদিন ১,০০০ ট্রাক, পুরো গাজাজুড়ে বিতরণ করবে জাতিসংঘ ও পেশাদার এনজিওগুলো।
গত সপ্তাহে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, 'আরও ভালো পরিকল্পনা থাকলে আমরা শুনতে রাজি।' পরদিনই জাতিসংঘ একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে—ত্রাণ কার্যক্রম ফের শুরু করা, পর্যবেক্ষণ বাড়ানো ও সহায়তার অপব্যবহার ঠেকাতে ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত অবিলম্বে সেই পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন জানানো।
অস্থায়ী পিয়ার, আকাশপথে সহায়তা বা নিরাপত্তায় ঘেরা কেন্দ্র—এসব খবরের শিরোনাম হতে পারে, কিন্তু পরিবারগুলোকে খাওয়াতে পারে না।
গাজার মানুষের পক্ষে আরেকটি “মানবিক সহায়তার পরীক্ষাগার” হওয়ার সুযোগ নেই। তাদের সময় ফুরিয়ে আসছে।
এই অবস্থায় ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র নতুন একটি ত্রাণ বিতরণ পরিকল্পনা এনেছে যেখানে চার-পাঁচটি কেন্দ্রীয় বিতরণ কেন্দ্র থাকবে, সেগুলোর নিরাপত্তা দেবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও বেসরকারি বাহিনী। এটি কার্যকর নয় বরং বিপজ্জনক। যখন মানুষ ক্ষুধার্ত, সেখানে সশস্ত্র পাহারার ভেতর খাদ্য বিতরণ মানেই সহিংসতার ঝুঁকি।
এই পরিকল্পনা বাস্তবতাবর্জিত। গাজায় হাজার হাজার পঙ্গু, বয়স্ক ও শিশু কীভাবে এই কেন্দ্রগুলোতে পৌঁছাবে? কীভাবে একজন মা ৪০ পাউন্ড খাদ্যবস্তা নিয়ে কিলোমিটার পাড়ি দেবে? ত্রাণ মানে শুধু খাবার নয়—চিকিৎসা, পানি, জ্বালানি ও নিরাপদ চলাচলের ব্যবস্থাও এর অন্তর্ভুক্ত।
অথচ কার্যকর বিকল্প রয়েছে—জাতিসংঘ ও এনজিওগুলোর শত শত ত্রাণবাহী ট্রাক সীমান্তে প্রস্তুত। কেবল ইসরায়েলকে অবরোধ তুলে দিতে হবে।
এই সময়ে রাজনৈতিক প্রতীকী পদক্ষেপ নয়, দরকার বাস্তব ও টেকসই মানবিক সমাধান। গাজার মানুষকে আর একটি ব্যর্থ “মানবিক পরীক্ষা”র ভুক্তভোগী করা যাবে না। কারণ তাদের সময় ফুরিয়ে আসছে।
ছাবেদ সাথী: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক-সাংবাদিক। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সম্পাদক বাংলা প্রেস।
[বাংলা প্রেস বিশ্বব্যাপী মুক্তচিন্তার একটি সংবাদমাধ্যম। স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের জন্য নিরপেক্ষ খবর, বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজ আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]
বিপি।এসএম
[বাংলা প্রেস হলো মুক্ত চিন্তার একটি বৈশ্বিক প্রচার মাধ্যম। এটি স্বাধীনচেতা মানুষের জন্য নিরপেক্ষ সংবাদ, বিশ্লেষণ ও মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজকের দিনে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]