
নিউ ইয়র্কের সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের পরিকল্পনা মামদানির


ছাবেদ সাথী
জোহরান মামদানি মনে হচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রে ‘সমতার’ এক নতুন সংজ্ঞা তৈরি করতে যাচ্ছেন। গণিত, ইংরেজি ও বিজ্ঞানে দুর্বল ফলাফল করা বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর মুখোমুখি হয়ে মামদানি এবার উচ্চ অর্জনকারী শিক্ষাপ্রোগ্রামগুলোই গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। এমন প্রতিশ্রুতি কেবল কোনো সোভিয়েত কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাবিদের কাছেই আনন্দের বিষয় হতে পারে।
প্রাথমিক পর্যায়ে মেধাবী ও প্রতিভাবানদের জন্য নির্ধারিত প্রোগ্রামগুলো বাতিল করে মামদানি মনে করছেন সমতা প্রতিষ্ঠা হবে—কিন্তু তা হবে গড়পড়তা মান তৈরি করে। বামপন্থীদের একাংশ যখন এসব বিশেষ প্রোগ্রাম পুরোপুরি বন্ধ করার দাবি তুলেছে, তখন উদ্বেগ বাড়ছে যে নিউ ইয়র্কও অন্যান্য উদারপন্থী শহরের পথেই হাঁটছে। (তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমো বলেছেন, তিনি বরং এসব প্রোগ্রাম সম্প্রসারণ করবেন)।
ওয়াশিংটন পোস্ট-এর সম্পাদকরাও এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করে বলেছেন, এটি 'সমতার নামে শিক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
যদিও মামদানি বর্তমানে নিম্ন শ্রেণিগুলোর ওপর জোর দিচ্ছেন, এই বিশেষ প্রোগ্রামগুলো দীর্ঘদিন ধরেই 'বর্ণবাদী' বা 'অধিকারভিত্তিক' হিসেবে সমালোচিত—কারণ, এসব শ্রেণিতে কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিনো শিক্ষার্থীর সংখ্যা মোটের এক-চতুর্থাংশেরও কম। সমালোচকরা বহুদিন ধরেই বলছেন, মেধাবী শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষের প্রায় ৭০ শতাংশই শ্বেতাঙ্গ ও এশীয়-আমেরিকান, অথচ তারা পুরো শিক্ষার্থীদের মাত্র ৩৫ শতাংশ।
ফলাফল হচ্ছে,মামদানির মতো রাজনীতিকরা কার্যত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পরিবার ও শিক্ষার্থীদের সরকারি শিক্ষা থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন। তাদের চলে যাওয়ার পরই প্রোগ্রামগুলোর মধ্যে দক্ষতার প্রকট পার্থক্যটিও মিলিয়ে যাবে।
মেধাবী ও প্রতিভাবানদের প্রোগ্রাম বহু পরিবারের কাছে গর্বের উৎস—যেখানে শিক্ষার্থীরা উন্নত প্রযুক্তি ও তত্ত্ব নিয়ে কাজ করে। মমদানি নিজেও একসময় এমন একটি স্কুলে (ব্রঙ্কস হাই স্কুল অব সায়েন্স) পড়েছিলেন। এসব প্রোগ্রামে ভর্তি হতে শিক্ষার্থীদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু কারও কাছে এই যোগ্যতাই যেখানে প্রাপ্যতার প্রতীক, অন্যদের কাছে সেটাই আবার সুবিধাবাদ বা বর্ণবৈষম্য।
এই শিক্ষার্থীরা প্রায়ই পুরো স্কুল ব্যবস্থার সঙ্গে একটি তীব্র ও অস্বস্তিকর তুলনা তৈরি করে—বিশেষত বর্ণ ও অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর পার্থক্যের কারণে। নিউ ইয়র্ক প্রতি বছর শিক্ষায় ব্যয় করে ৪১ বিলিয়ন ডলার—অর্থাৎ প্রতি শিক্ষার্থী প্রায় ৩৬,২৯৩ ডলার। এই অর্থের একটি বিশাল অংশ ব্যয় হয় স্ফীত প্রশাসনিক কাঠামোর পেছনে, যা বহু বছর ধরে শিশুদের ব্যর্থ করছে। গত বছর শহরের ৪০ শতাংশের বেশি প্রাথমিক শিক্ষার্থী গণিত ও পাঠ দক্ষতার মান পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে। সামান্য কিছু অগ্রগতি দেখা গেলেও, তা পরীক্ষার মানদণ্ড কমিয়ে আনার ফল হতে পারে।
দেশজুড়ে অনেক স্কুল জেলা যোগ্যতার মানদণ্ড নামিয়ে আনছে এবং মানসম্মত পরীক্ষা বাতিল করছে—যাতে কৃত্রিম সাফল্যের চিত্র তুলে ধরা যায়। বিপুল অর্থ ব্যয় করেও এসব স্কুল থেকে বেরিয়ে আসা শিক্ষার্থীরা নতুন অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা করতে বা দারিদ্র্যের চক্র থেকে মুক্তি পেতে ব্যর্থ হচ্ছে। এই নতুন ধারণা, 'সমতার নামে গ্রেডিং,' মূলত পরীক্ষার মান বিকৃত করে সাফল্যের ভান সৃষ্টি করছে।
কিছু জেলা আবার পরীক্ষার পরিবর্তে 'শিক্ষার আনন্দ'কে অগ্রাধিকার দেওয়ার পরিকল্পনা নিচ্ছে—যেখানে ফলাফল পরিমাপের কোনো মানদণ্ড থাকবে না।
এই ব্যর্থ শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরে মেধাবী শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও অনেক সময় অস্বস্তিকর মনে হয়। ফলে যখন এসব বিশেষ প্রোগ্রাম তুলে দেওয়া হবে, অনেক পরিবারই সম্ভব হলে সরকারি শিক্ষা থেকে সরে যাবে।
অনেক জেলাতেই দেখা যাচ্ছে, পরিবারগুলো সরকারি স্কুল ছেড়ে ধর্মীয় বা বেসরকারি স্কুলে যাচ্ছে—যেখানে মূল শিক্ষাদক্ষতার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়। তারা ক্লান্ত জেলা প্রশাসনের অর্থ অপচয় দেখে—যেখানে কোটি কোটি ডলার ব্যয় হচ্ছে ‘ধ্যান’ বা ‘ওয়োক’ প্রকল্পে, অথচ শিক্ষার মান স্থবির বা অবনতিশীল।
এই অবস্থার জবাবে অনেক রাজনীতিক স্কুল ভাউচার প্রোগ্রাম বা বিকল্প শিক্ষা উদ্যোগের বিরোধিতা করছেন। মামদানি যেমন ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসার বিকল্প হিসেবে রাষ্ট্র-চালিত দোকান প্রতিষ্ঠার মতো সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনা করছেন, তেমনি সরকারি স্কুলের বিকল্প কোনো ব্যবস্থা দেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহী নন। স্কুল কর্তৃপক্ষ ও ইউনিয়নও স্কুল পছন্দের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে, কারণ তারা জানে—যদি অভিভাবকদের প্রকৃত বিকল্প দেওয়া হয়, তবে অধিকাংশই সরকারি স্কুলের নিম্নমানের শিক্ষাসেবা থেকে সরে যাবে। অনেকে ইতিমধ্যেই তাই করছেন।
এখন মামদানি সেই সীমিত প্রবাহকে সুনামিতে রূপ দিতে চলেছেন। সবচেয়ে মেধাবী ও উদ্যমী শিক্ষার্থীদের সরকারি স্কুলে রাখার বদলে, তিনি কার্যত তাদের ‘শীর্ষ দশ শতাংশ’ অংশটিই ছেঁটে ফেলতে যাচ্ছেন। তিনি প্রাক্তন মেয়র বিল ডি ব্লাসিওর সেই বিপর্যয়কর নীতির পথেই হাঁটছেন, যা পরে বাতিল করতে হয়েছিল।
যদি এই পরিকল্পনা প্রাথমিক শ্রেণির বাইরে সম্প্রসারিত হয়, তবে নিউ ইয়র্কের শিক্ষার্থীরা আর সর্বোচ্চ পর্যায়ে কাজ করার সুযোগ পাবে না। নিউ ইয়র্কের শিক্ষাব্যবস্থা সবার জন্যই সমান সুযোগ রাখে—যদি কেউ যথেষ্ট পরিশ্রম করে যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। এতে অশ্বেতাঙ্গ শিক্ষার্থীরাও এলিট কলেজ বা চাকরির সুযোগ পেতে পারে। প্রাথমিক স্তরেই এসব শিক্ষার্থীর প্রতিভা বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ সময়।
শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব মারাত্মক হতে পারে। এখন তাদের এমন শিক্ষার্থীদের সামলাতে হবে, যাদের অগ্রগতির জন্য অনেক বেশি মনোযোগ ও দক্ষতা প্রয়োজন। কিছু মেধাবী শিক্ষার্থী থাকলে শিক্ষকরা তাদের অবহেলা করে গড় শিক্ষার্থীদের দিকে বেশি মনোযোগ দেন, ফলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা স্থবির হয়ে পড়ে।
এটি মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য ধ্বংসাত্মক হতে পারে। বিশেষ প্রোগ্রামগুলো তাদের পূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক সম্ভাবনা অর্জনের সুযোগ দেয়। চ্যালেঞ্জ না পেলে তারা হতাশ ও অনুৎসাহী হয়ে উঠতে পারে—যা একসময় তাদের সম্ভাবনাময় জীবন ধ্বংস করতে পারে।
আমাদের সরকারি শিক্ষার মানহ্রাস ইতিমধ্যেই উচ্চশিক্ষায় প্রতিফলিত হচ্ছে। সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে তার ছাত্রদের জন্য মৌলিক গণিত কোর্স চালু করতে হয়েছে, কারণ তারা কলেজ-স্তরের পড়াশোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না।
অনেকের মতে, সমাধান মেধাবীদের প্রোগ্রাম বাতিল করা নয়, বরং পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে সেই দক্ষতার স্তরে উন্নীত করা। অবশ্য এটি বলা সহজ, করা কঠিন—বিশেষত সেই শিক্ষাব্যবস্থার জন্য, যা দশকের পর দশক ধরে নগর-অভ্যন্তরের শিশুদের ব্যর্থ করেছে।
মামদানির ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে, সবাইকে 'সর্বনিম্ন মানে নামিয়ে আনা”র মধ্যে এক ধরনের রাজনৈতিক তৃপ্তি আছে। তিনি সাদা ও এশীয় পরিবারের শিশুদের “বিশেষ সুবিধা”র বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এখন শিক্ষাক্ষেত্রেও সেই সোভিয়েত-ধাঁচের সমতা চাপিয়ে দিতে চাইছেন—যেখানে পছন্দের সুযোগ থাকবে কেবল কয়েকটি নিরস বিকল্পে সীমিত।
সাংবাদিক এইচ.এল. মেনকেন একবার বলেছিলেন, সরকারি শিক্ষা হলো “যত বেশি সম্ভব মানুষকে এক নিরাপদ মানে নামিয়ে আনার প্রচেষ্টা… বিদ্রোহ ও মৌলিক চিন্তাকে দমন করা। মমদানি যেন সেই মেনকেনের আশঙ্কাকেই বাস্তবে রূপ দিতে চলেছেন।
ছাবেদ সাথী: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক ও মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সম্পাদক বাংলা প্রেস
আপনি এগুলোও পছন্দ করতে পারেন





