১৩ অক্টোবর ২০২৫

কেন নেতানিয়াহুর কথা শোনা বন্ধ করলেন ট্রাম্প

Logo
বাংলা প্রেস প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৪২ পিএম
কেন নেতানিয়াহুর কথা শোনা বন্ধ করলেন ট্রাম্প
  ছাবেদ সাথী প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ইসরায়েলের একনিষ্ঠ ও প্রতিক্রিয়াশীল সমর্থক হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু এবার, সেই চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। ওয়াশিংটনের জেরুজালেম থেকে কতটা দূরত্ব তৈরি হবে -বিশেষত ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি ইস্যুতে-তা কেবল যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের জন্যই নয়, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্পের কাছে বিদেশি নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কই দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের প্রতিফলন। তিনি যদি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখেন, তবে সেটিই হবে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্কের সূচক এবং এর উল্টোটাও সত্য। আজ, এই দুই সম্পর্ক পুরোপুরি ভাঙেনি ঠিকই, কিন্তু এর চাপ ও টানাপড়েন ক্রমেই বাড়ছে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে ইসরায়েলপন্থী ইভানজেলিক খ্রিস্টান ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণে ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ওবামার ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করার এবং ইসরায়েলকে সর্বোচ্চ সমর্থন দেওয়ার। ২০১৮ সালে তিনি সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন। তদুপরি, তিনি মার্কিন দূতাবাস তেলআভিভ থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তর করেন, ফিলিস্তিনি লিয়াজোঁ অফিসকে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক মিশনে একীভূত করেন, গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলি সার্বভৌমত্ব স্বীকৃতি দেন এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইসরায়েলকে রক্ষা করেন। এইসব পদক্ষেপের পেছনে রাজনৈতিক বিনিময় ছিল স্পষ্ট-নেতানিয়াহুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা বা অন্তত সেই সম্পর্ক দেখানো ছিল কৌশলের অংশ। প্রথম মেয়াদে সেই সম্পর্ক কতটা আন্তরিক ছিল, তা বিতর্কের বিষয় হতে পারে। তবে মূল চালিকা শক্তি ছিল ট্রাম্পের ২০২০ এবং পরবর্তী ২০২৪ সালের নির্বাচনে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার অভিলাষ। দুইবারই ইসরায়েলপন্থী ভোট ধরে রাখাকে তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। নেতানিয়াহুর সঙ্গে সম্পর্কের ফাটল থাকলেও সেসব তখন তেমন প্রকাশ্যে আসেনি। ২০২৪ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প ইভানজেলিক ভোট ধরে রাখতে পেরেছিলেন, যদিও হ্যারিসের কাছে ইহুদি ভোটে ৩৪ পয়েন্টে হেরে যান। এমনকি অনেক হ্যারিস সমর্থকও বিশ্বাস করতেন ট্রাম্পই ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষা করতে পারেন। কিন্তু এখন সেই নির্বাচনী বাধ্যবাধকতা নেই। ট্রাম্প কার্যত স্বীকার করেছেন যে তিনি আর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না। এরই মধ্যে ২০২০ সালে ইরানি জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা অভিযানে নেতানিয়াহুর ভূমিকার প্রচার, জো বাইডেনকে দ্রুত অভিনন্দন জানানো এবং প্রায়ই ট্রাম্পের চেয়েও বেশি গণমাধ্যমের মনোযোগ কাড়ার ক্ষমতা-এসবই ব্যক্তিগত সম্পর্কে বরফ জমতে সাহায্য করেছে। এর পেছনে ওবামার নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া নিয়ে ট্রাম্পের ঈর্ষা কাজ করেছিল বলেও ধারণা করা হয়। ফলে মাত্র চার মাসেই ট্রাম্প ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলাদা শান্তিচুক্তি করেছেন, রেড সি জাহাজ চলাচলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়ে কার্যত ইসরায়েলকে একা ফেলে দিয়েছেন, যখন হুথি ক্ষেপণাস্ত্র তেলআভিভের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরকে লক্ষ্য করে ছোড়া হচ্ছিল। এছাড়া হোয়াইট হাউস, ইসরায়েলকে বাইরে রেখেই হামাসের সঙ্গে আলোচনা করে আমেরিকান বন্দি এডান আলেকজান্ডারকে মুক্ত করেছে। ট্রাম্পের প্রথম বিদেশ সফর হয়েছে তিনটি উপসাগরীয় আরব দেশে, কিন্তু ইসরায়েল বাদ পড়েছে -যা তার প্রথম মেয়াদের পুরো বিপরীত। সৌদি আরবে থাকাকালীন তিনি সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছেন, যা ইসরায়েলের সঙ্গে স্পষ্টভাবে মতবিরোধ তৈরি করেছে। তবে পুরো রেকর্ড নেতিবাচক নয়। ট্রাম্প আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছেন, যারা নেতানিয়াহু ও তাঁর সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছিল। তিনি হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অভিযানে সাধারণভাবে সমর্থন দিয়েছেন, যদিও তা পুরোপুরি নয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় মতবিরোধ দেখা দিয়েছে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ইস্যুতে। ৭ এপ্রিল, শপথ নেওয়ার পর নেতানিয়াহুর দ্বিতীয় ওভাল অফিস সফরে ট্রাম্প ঘোষণা দেন যে স্টিভ উইটকফ শিগগিরই ইরানের সঙ্গে আলোচনা করবেন-শুনে নেতানিয়াহু অবাক হয়ে যান। ট্রাম্প আগেই ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনির কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, আলোচনায় প্রস্তুতির কথা জানিয়ে দুই মাস সময় বেঁধে দিয়েছিলেন, ব্যর্থ হলে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। যদি চিঠি পাওয়ার তারিখ থেকে সময় গণনা করা হয়, সেই সময়সীমা ইতিমধ্যে শেষ। আর যদি এপ্রিল ১২-তে ওমানে উইটকফ-ইরান বৈঠক থেকে সময় গণনা হয়, তাহলে সেই সীমাও কাছাকাছি। ট্রাম্প সময় বাড়াতেও পারেন, কিন্তু তাতে শুধু ইসরায়েলের ঝুঁকিই বাড়বে। ‘অন্তর্বর্তী’ বা ‘ফ্রেমওয়ার্ক’ চুক্তির খবর ইঙ্গিত দেয়, ইরান হয়তো ওয়াশিংটনকে সময়ক্ষেপণে ব্যবহার করছে। সময় সবসময় পারমাণবিক অস্ত্রপ্রসারের পক্ষে কাজ করে। আলোচনা যত দীর্ঘায়িত হবে, তত ইরান তাদের কর্মসূচিকে ছড়িয়ে দিতে, লুকাতে ও নিরাপদ করতে পারবে। ট্রাম্প স্বীকার করেছেন, তিনি একাধিকবার ইসরায়েলকে ইরান আক্রমণ না করার অনুরোধ করেছেন। এমন কঠিন সময়ে মিত্রকে প্রকাশ্যে নিরুৎসাহিত করা এক বিস্ময়কর কৌশল, যা উইটকফের আলোচনাকে বাঁচাতে ট্রাম্প কতটা মরিয়া তা বোঝায়। আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে নিশ্চিত তথ্য নেই, কিন্তু ইঙ্গিত মিলেছে বিশৃঙ্খলা, দ্বিধা ও এমনকি অদক্ষতার-বিশেষত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে, যা ওবামার চুক্তির অন্যতম প্রধান ভুল ছিল। নেতানিয়াহুর উদ্বিগ্ন হওয়াটা তাই যথার্থ। ট্রাম্পের এই আচরণ নেতানিয়াহুর সঙ্গে ব্যক্তিগত দূরত্ব এবং নিজেকে প্রধান নায়ক হিসেবে তুলে ধরার প্রবণতার পরিচয় দেয়-যেন ইসরায়েল নয়, তিনিই হবেন ইরানের হুমকির মোকাবিলায় মুখ্য ব্যক্তি। তাঁর প্রশাসনের মধ্যে থাকা কিছু অন্তর্মুখী কণ্ঠের প্রভাবও এতে থাকতে পারে, যদিও রিপাবলিকানদের মধ্যে মোটেও তা জনপ্রিয় নয়। ইতিমধ্যেই ৫২ জন সিনেটর ও ১৭৭ জন কংগ্রেসম্যান ট্রাম্পকে অনুরোধ করেছেন, যেন ইরানকে কোনো ‘লাইফলাইন’ না দেওয়া হয়। ইসরায়েল ১৯৮১ সালে ইরাকের অসিরাক চুল্লি বা ২০০৭ সালে সিরিয়ায় নির্মাণাধীন ইরানি চুল্লি ধ্বংস করার সময় কারও অনুমতির প্রয়োজন মনে করেনি। নেতানিয়াহুকে যদি ট্রাম্প মনে করেন ‘পিছু হটবেন’, তাহলে সেটা হবে ভয়াবহ ভুল। সময় আসলে নেতানিয়াহুই উদ্যোগ নেবেন। যখন সময় আসবে, নেতা উঠে আসবেই। ছাবেদ সাথী: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক-সাংবাদিক। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সম্পাদক বাংলা প্রেস। [বাংলা প্রেস বিশ্বব্যাপী মুক্তচিন্তার একটি সংবাদমাধ্যম। স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের জন্য নিরপেক্ষ খবর, বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজ আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।] বিপি।এসএম
[বাংলা প্রেস হলো মুক্ত চিন্তার একটি বৈশ্বিক প্রচার মাধ্যম। এটি স্বাধীনচেতা মানুষের জন্য নিরপেক্ষ সংবাদ, বিশ্লেষণ ও মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজকের দিনে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]

মন্তব্য (0)

আলোচনায় যোগ দিন

আপনার মতামত শেয়ার করতে এবং অন্যান্য পাঠকদের সাথে যুক্ত হতে দয়া করে লগইন করুন।

এখনো কোন মন্তব্য নেই

Be the first to share your thoughts on this article!