
ছাবেদ সাথী
মার্কিন কূটনীতিক হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে ক্যারিয়ার গড়া এক ধরণের নম্রতার শিক্ষাও বটে। যখনই কোনো সদিচ্ছাপূর্ণ মার্কিন কর্মকর্তা “নতুন মধ্যপ্রাচ্যের” প্রসবে বেদনার কথা বলতেন, তখনই বুঝতে হতো এবার হয়ত দূতাবাস খালি করার প্রস্তুতি নিতে হবে, বাঙ্কারগুলোতে খাবার-পানি মজুদ করতে হবে।
আর যদি কেউ লেবাননে শান্তির কথা বলতেন, তবে তাকে বাস্তবতা বিচ্যুত কিনা তা বোঝার জন্য আইকিউ টেস্ট নেওয়া প্রয়োজন হতো। কেননা মার্কিন-লেবানন সম্পর্কের ইতিহাস একের পর এক অতিরঞ্জিত প্রত্যাশা, হতাশাজনক পরিণতি এবং অনেক মরদেহে ভরা। তবুও, এইবার পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে।
এইবার এক নতুন সম্ভাবনার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে,সত্যিকারের শান্তির সম্ভাবনা। শুধু যুদ্ধবিরতি নয়, কেবল অস্ত্রবিরতি নয়, বরং ইসরায়েল ও লেবাননের মধ্যে একটি স্থায়ী শান্তিচুক্তির বাস্তব সুযোগ।
দুই পাশের অনেকেই বলেছে, আমি পাগল। কিন্তু কেউই যুক্তি দিয়ে দেখাতে পারেনি কেন এটি অসম্ভব। একটি প্রাচীন লেবাননি প্রবাদ রয়েছে 'লেবানন প্রথম আরব দেশ হবে না যারা ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করবে, তবে শেষটিও হবে না।' আশির দশক থেকে কিছু মাস আগ পর্যন্ত এই নীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল সিরিয়া ও ইরানের হাতে। তখন এই প্রবাদটি ছিল রীতিমতো রসিকতা।
ইরানি ধর্মীয় নেতারা ও সিরিয়ার আসাদ পরিবার, তাদের লেবাননি প্রতিনিধি হিজবুল্লাহর মাধ্যমে যুদ্ধ ও শান্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা নিজেরা নিরাপদে থেকে দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ উসকে দিত। ২০০০ সালে ইসরায়েলি বাহিনী জাতিসংঘের স্বীকৃত সীমানা অনুযায়ী দক্ষিণ লেবানন থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরও হিজবুল্লাহ দুই দশক ধরে সেই যুদ্ধ চাপিয়ে রাখে, মূলত সিরিয়া ও ইরানের স্বার্থে, যার মাশুল দিয়েছে লেবাননের সাধারণ মানুষ।
কিন্তু আজ সেই পরিস্থিতি বদলে গেছে। হিজবুল্লাহর যুদ্ধক্ষমতা ধসে পড়েছে, আসাদ পরিবার এখন দামেস্ক নয়, মস্কোতে অবস্থান করছে, আর তেহরান নিজস্ব আকাশসীমাই রক্ষা করতে পারছে না প্রভাব বিস্তারের কথা তো দূরের। এর ফলস্বরূপ, লেবানন ও ইসরায়েলের জন্য এক অভূতপূর্ব কূটনৈতিক সুযোগ তৈরি হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় কূটনীতিতে সময়ই সব এই মুহূর্তে ইসরায়েল-লেবাননের মধ্যে শান্তির পথে এগোনোর সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এখন লেবানন আর বিদেশি স্বার্থের হাতে বন্দি নয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবও যথেষ্ট।
দীর্ঘ যুদ্ধ ও ধ্বংসের পর শান্তির দিকে মানসিকভাবে এগোনো কঠিন বটে। তবে বাস্তব সমস্যাগুলো খুব জটিল নয়। এখানে কোনো ভূখণ্ডগত বিরোধ নেই। ইসরায়েলের আগ্রহ নিরাপত্তায়, লেবাননের জমিতে নয়। হিজবুল্লাহ পূর্বতন ঔপনিবেশিক সীমানা-ভুল ব্যাখ্যা করে 'অবসানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ'-এর অজুহাত দাঁড় করিয়েছিল, যা আজ লেবাননে খুব কম মানুষই গুরুত্ব দেন।
মূল বিষয়টি নিরাপত্তা। ২০২৪ সালের অস্ত্রবিরতি চুক্তি পুরোপুরি কার্যকর হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে, তবে তা রাজনৈতিক শূন্যতায় সম্ভব নয়। অস্ত্রবিরতিতে বলা হয়েছে, ইসরায়েল সীমান্ত থেকে লিটানি নদী পর্যন্ত (প্রায় ১৮ মাইল) অঞ্চল থেকে হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করতে হবে। এই লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় প্রস্তুত লেবানন সেনাবাহিনী কিছুটা অগ্রগতি করলেও এখনও দক্ষিণে সম্পূর্ণ কাজ শেষ হয়নি এবং অন্য অঞ্চলগুলোতেও শুরু হয়নি।
যদি লেবাননের সরকার হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র না করে, তবে ইসরায়েলি বাহিনী সেটা করে ফেলবে যা লেবাননের সরকারের জন্য চরম অপমান, এবং পুরো দেশের জন্য হবে এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। এই সুযোগটি না কাজে লাগানো হলে, তারা নিজেদের রাষ্ট্রের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনাও হারাবে।
তবে লেবাননের সংকট কেবল নিরাপত্তা নয়, রাজনৈতিকও। ইরানি প্রভাব চলে গেলেও দেশটিতে সাম্প্রদায়িক বিভাজন নতুন উত্তেজনা তৈরির আশঙ্কায় সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে হিজবুল্লাহর অস্ত্র ও রাষ্ট্রের ভিতরে আরেক রাষ্ট্র হিসেবে কাজ করার সুবিধা পেয়েছে লেবাননের শিয়ারা তাদের মধ্যে এখন আশঙ্কা, এই অবস্থার পরিবর্তনে ইসরায়েলি বা অন্য সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রতিশোধ আসতে পারে।
সত্যিকারের শান্তি যুদ্ধবিরতির বাইরের প্রসঙ্গ এই জড়তা কাটাতে সহায়ক হতে পারে। আমি যেসব লেবাননবাসীর সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের অধিকাংশের কল্পনায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক মানে ১৯৪৯ সালের অস্ত্রবিরতির পুনরাবৃত্তি। অথচ সেই চুক্তি কখনো স্থগিত হয়নি, আবার তা কখনোই যুদ্ধ বা সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন ঠেকাতে পারেনি না ইসরায়েলি, না ফিলিস্তিনি, না সিরিয়ান, না ইরানিদের পক্ষ থেকে।
অনেকে আরব আমিরাতের মতো 'স্বাভাবিকীকরণ চুক্তি'-র বিরোধিতা করেছেন। তবে শান্তিচুক্তির ধরন অংশীদার রাষ্ট্রদ্বয় নির্ধারণ করে এটি আব্রাহাম অ্যাকর্ডের মতো হতেই হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এক শক্তিশালী শান্তিচুক্তি দক্ষিণ লেবাননের মানুষকে আশ্বস্ত করবে যে, তাদের ভবিষ্যৎ একটি শান্তিরক্ষাকারী সেনাবাহিনীর হাতে নিরাপদ যেমন মিশর বা জর্ডানের সঙ্গে ইসরায়েলের চুক্তিগুলো এখন পর্যন্ত টিকে আছে।
আর বাস্তবতা হলো, এটাই একমাত্র উপায় যাতে দক্ষিণ লেবাননে বিনিয়োগ, প্রবাসীদের অর্থ ও পর্যটনের মাধ্যমে আস্থা ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনা সম্ভব—যা এক দুর্বিষহ অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত একটি জাতিকে আবার গড়ে তুলতে পারে।
এই মুহূর্তে প্রয়োজন সক্রিয়, সুশৃঙ্খল, এবং নিরবিচার মার্কিন কূটনীতি শুধু অস্ত্রবিরতি কার্যকর নয়, বরং পূর্ণাঙ্গ শান্তিচুক্তির পথ তৈরি করা এবং আঞ্চলিক শক্তির পুনর্গঠনকে সংহত করা, যার সূচনা ট্রাম্প সাম্প্রতিক ইরান হামলার মাধ্যমে করেছেন। মার্কিন কূটনীতি পারবে ইরান-চালিত বহু আঞ্চলিক সমস্যা—বিশেষ করে লেবাননের সমস্যাগুলো এখন থেকে বাদ দিতে।
তবে এই সুযোগ চিরকাল থাকবে না।
ছাবেদ সাথী: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক ও মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[বাংলা প্রেস বিশ্বব্যাপী মুক্তচিন্তার একটি সংবাদমাধ্যম। স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের জন্য নিরপেক্ষ খবর, বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজ আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]
বিপি।এসএম
[বাংলা প্রেস হলো মুক্ত চিন্তার একটি বৈশ্বিক প্রচার মাধ্যম। এটি স্বাধীনচেতা মানুষের জন্য নিরপেক্ষ সংবাদ, বিশ্লেষণ ও মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজকের দিনে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]