
মামদানি ও ভ্যান্স: আমেরিকা-বিরোধী 'একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ'


ছাবেদ সাথী
এই প্রথমবারের মতো, দুই প্রধান মার্কিন রাজনৈতিক দলই একটি নিশ্চিত বিপদের দিকে ধাবিত হচ্ছে—আর সেই ধ্বংসযাত্রায় দেশকেও টেনে নিচ্ছে সঙ্গে করে।
যারা আমাদের মধ্যে এখনো যুক্তিবাদী ও মধ্যপন্থী, তাদের যথেষ্ট কারণ রয়েছে ভয় পাওয়ার। আমরা হয়তো শিগগিরই সেই সময়টির জন্য হাহাকার করব, যখন বারাক ওবামা ছিলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির উদীয়মান মুখ, মামদানি নয় এবং যত অদ্ভুতই শোনাক, ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন রিপাবলিকানদের নেতা ছিলেন, জেডি ভ্যান্স নয়।
ডানপন্থীরা একসময় ওবামাকে বলত অ-আমেরিকান, দেশপ্রেমহীন, শক্তির মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অক্ষম। কিন্তু বাস্তবে ওবামা সেসব কিছুই ছিলেন না। শ্বেতাঙ্গ ক্যানসাস আর কৃষ্ণাঙ্গ শিকাগোর মিশ্র প্রজন্মের সন্তান ওবামা, দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পূর্বসূরি রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের চেয়েও বেশি ড্রোন হামলা চালিয়েছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে। হয়তো তিনি মাঝে মাঝে ‘আইডেন্টিটি-লেফট’-এর প্রতি ঝুঁকে পড়তেন, তবে তার আশাবাদ ও বাস্তবতাবোধের মিশেল তাঁকে সেই বিভক্তিকর, অতীতমুখী চিন্তাধারার বিরোধীতায় দাঁড় করিয়েছিল। এটাই তো সত্যিকারের আমেরিকান চেতনা।
কিন্তু আমি শঙ্কিত, ডেমোক্রেটিক পার্টির আগামী প্রজন্ম—যার প্রতীক হলেন মামদানি—বাস্তবেই হবে অ-আমেরিকান, দেশপ্রেমহীন এবং শান্তি রক্ষায় অক্ষম; শুধু বিদেশে নয়, দেশের শহরগুলোর রাস্তায়ও। মামদানি তার শাসনভাবনা স্পষ্ট করেছেন টিকটকে পোস্ট করা নানা প্রযুক্তিনির্ভর অথচ তথ্যহীন নীতিপ্রস্তাবে, যেগুলো উচ্চশিক্ষিত তরুণ অভিজাত ও অভিবাসীদের একাংশকে মোহিত করে। কিন্তু ব্রঙ্ক্সের কৃষ্ণাঙ্গ ভোটার কিংবা স্ট্যাটেন আইল্যান্ডের শ্বেতাঙ্গ নৃগোষ্ঠীগুলোর কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি।
২০২৪ সালের ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কনভেনশনে কমলা হ্যারিস যে বহুজাতিক, বহু বর্ণের দৃশ্যপট তৈরি করেছিলেন, সেটি ছিল কেবল তিনটি রঙে রাঙানো—লাল, সাদা, নীল। এর ঠিক বিপরীত দৃশ্য দেখা গেছে মামদানির বিজয়োৎসবে—সেখানে কোনো আমেরিকান প্রতীকই দেখা যায়নি। মামদানির নিউ ইয়র্ক হলো এক শিকড়হীন, বিশ্বায়িত শহর, যার কাছে দেশপ্রেমের কোনো মূল্য নেই—না ইসরায়েলের অস্তিত্ব, না আমেরিকার। এটাই হচ্ছে আধুনিক বামপন্থার নতুন রূপের অ্যান্টি-আমেরিকানিজম।

অন্যদিকে, বামপন্থীরা ট্রাম্পকে বলেছে ফ্যাসিস্ট ও বর্ণবাদী। বাস্তবে, ট্রাম্প এক রুক্ষ স্বভাবের, ঔদ্ধত্যপূর্ণ নিউ ইয়র্কের হোটেল ব্যবসায়ী ও রিয়েলিটি টিভি তারকা, যিনি রাষ্ট্র ও ব্যক্তিগত ব্যবসা—উভয় জায়গাতেই নানা পরিচয়ের মানুষকে নিয়োগ দিয়েছেন (আবার বরখাস্তও করেছেন)। তার প্রজন্মের অনেক সিইও-এর মতোই, তিনি অন্যদের মূল্য নির্ধারণ করেন একমাত্র তার প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে।
রাষ্ট্রপতিদের কি মাফিয়া ডনের মতো আচরণ করা উচিত? অবশ্যই না। কিন্তু একজন আত্মমগ্ন, আদর্শহীন মনোযোগকামী ট্রাম্পের চেয়েও খারাপ কিছু আসছে বলেই আমি ভয় পাচ্ছি।
ভ্যান্সের মধ্যে যে রিপাবলিকান ভবিষ্যৎ দেখা যাচ্ছে, তা সত্যিকারের নেটিভিস্ট—জাতিগত জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। সঙ্গে আছে এক ধরনের সৌম্যরূপী পুরুষতান্ত্রিকতা। তারা এটিকে 'মেধাভিত্তিকতা' বলে সাজিয়ে তুলে ধরবে। ভ্যান্স ২০২৪ সালের রিপাবলিকান কনভেনশনে তার আমেরিকা-ভাবনার রূপরেখা স্পষ্ট করেন।
তিনি বলেন, 'আমেরিকা শুধু একটি ধারণা নয়।' তাঁর বক্তব্যে মিলে যায় 'গ্যাংস অফ নিউ ইয়র্ক' ছবির ‘বিল দ্য বাচার’ এবং ১৯ শতকের “নো নাথিং” আন্দোলনের জাতিবিদ্বেষ। ভ্যান্সের মতে, কেন্টাকির পাহাড়েই তার মৃতদেহ সমাহিত হবে তার বহু প্রজন্মের পূর্বপুরুষদের পাশে।
এ হলো 'রক্ত ও মাটি' জাতীয়তাবাদের রূপ, যা রিপাবলিকান দলে বহুদিন ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে। একে প্রথমে ঠেকিয়ে রেখেছিল জর্জ ডব্লিউ বুশের নিউ ইংল্যান্ডীয় এলিট ভাবনা ও টেক্সান সমতা চিন্তা, পরে ট্রাম্পের নিউ ইয়র্ক কেন্দ্রিক বিশ্বচেতনা, যার থেকে 'আমেরিকা ফার্স্ট'-এর চিন্তা কখনো পুরোপুরি আলাদা হয়নি। কিন্তু এখন, ভ্যান্স এবং তার 'ব্রো-পডকাস্টার' দলের মাধ্যমে রিপাবলিকানদের নতুন অ্যান্টি-আমেরিকানিজম হচ্ছে নেটিভিস্ট জাতীয়তাবাদ।
মামদানি ও ভ্যান্স কী পরিমাণ পরিবর্তনের প্রতীক তা বুঝতে হলে ভাবুন—ওবামা, ট্রাম্প, হ্যারিস, বুশসহ যাদের আমরা এখনো জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে দেখি, তারা সবাই একমত ছিলেন: ইরানের হাতে পরমাণু অস্ত্র থাকা উচিত নয়।
কিন্তু মামদানি তা মনে করেন না, কারণ তার দৃষ্টিতে ইসরায়েল ও আমেরিকা—দু’টিই ইরানের মতোই দোষী। তার অনুসারীদের কাছে “গ্লোবালাইজ দ্য ইন্তিফাদা” হলো নতুন 'উই শ্যাল ওভারকাম।' আর ভ্যান্স? ট্রাম্প প্রশাসনের সদস্য হওয়ায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার কথা তাকে বলতেই হয়েছে, তবে বাস্তবে তেমন আগ্রহ নেই। তার কাছে 'আমেরিকা ফার্স্ট' মানেই 'আমেরিকা একা।'
এই সত্য মেনে নেওয়ার জন্য—যে ইরানের হাতে পরমাণু অস্ত্র থাকা উচিত নয়, নিউ ইয়র্কে পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো দরকার, আর ভ্যান্সের প্রথম প্রজন্মের আমেরিকান স্ত্রীও তার মতোই আমেরিকান—আমাদের উভয় দিকের নতুন অ্যান্টি-আমেরিকানিজমকে প্রত্যাখ্যান করতেই হবে।
সব কথা ছাপিয়ে, আমরা যতই বলি না কেন, আমেরিকা এতদিন ছিল এক ব্যতিক্রম। বাকি বিশ্বের মতো উপজাতিগত রাজনীতি এখানে প্রকট হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন রাজনীতিতে চরমপন্থা খুব কমই জায়গা পেয়েছে—প্রগতিশীল নেতারা হননি নিপীড়ক বা বিশৃঙ্খলাবাদী, আর রক্ষণশীল নেতারাও হননি ফ্যাসিস্ট বা জাতিবাদী।
তবুও, আমরা এসব শব্দ ছুঁড়ে দিয়েছি অবহেলায়—একটি জাতি হয়ে যে নেকড়ে ছানার গল্পে মিথ্যা হুঁশিয়ারি দিতে দিতে সত্যিকারের বিপদ ডেকে এনেছে। এখন হয়তো সেই বিপদ সামনে—বাম ও ডান দুই দিক থেকেই নতুন, কণ্ঠস্বর-সজ্জিত, ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী অ্যান্টি-আমেরিকানিজমের রূপে।
ছাবেদ সাথী: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক ও মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[বাংলা প্রেস বিশ্বব্যাপী মুক্তচিন্তার একটি সংবাদমাধ্যম। স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের জন্য নিরপেক্ষ খবর, বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজ আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।] বিপি।এসএমআপনি এগুলোও পছন্দ করতে পারেন





