
মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে ট্রাম্পের অভিবাসন অভিযান



ছাবেদ সাথী
ক্যালিফোর্নিয়ার ম্যাকআর্থার পার্ক থেকে সোমবার যেসব পরিবার পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল, তাদের কাছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সর্বশেষ আইসিই (ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট) অভিযানটি যেন একটি সামরিক আগ্রাসনের মতোই মনে হয়েছে। এই বিশাল অভিযান পরিচালনায় ছিল নয়টি ফেডারেল সংস্থা, ন্যাশনাল গার্ড, স্থানীয় পুলিশ এবং এক ডজনেরও বেশি সাঁজোয়া সামরিক যান। এমন এক ‘শক অ্যান্ড অ-অভিযান, যা যেন ফালুজায় বেশি মানায়, লস অ্যাঞ্জেলসের শান্তিপূর্ণ কোনো পার্কে নয়।
অভিযানে অংশ নেওয়া সংস্থাগুলো মনে করেছিল যেন তারা কোনো সামরিক অভিযান চালাচ্ছে। ঘটনাস্থলের ছবি দেখা গেছে ফেডারেল এজেন্টরা ক্যামোফ্লাজ যুদ্ধবাহিনীর পোশাকে সাঁজোয়া ট্রাক থেকে বেরিয়ে আসছে, আর হতবাক সাধারণ মানুষ ভয়ে তাকিয়ে আছে। আইসিই এমনকি অভিযানের একটি বাহারি, যুদ্ধধর্মী নামও দিয়েছে: 'অপারেশন এক্সক্যালিবার।'
ট্রাম্পের দমনমূলক অভিবাসন অভিযান হয়তো তার মাগা (মেইক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন) ঘাঁটির কাছে জনপ্রিয়, কিন্তু এটি ধীরে ধীরে বাকিদের—এমনকি মূলধারার রক্ষণশীল রিপাবলিকানদেরও বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে, যাদের সমর্থন ছাড়া আগামী নির্বাচনে কংগ্রেসে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখা অসম্ভব হবে।
ম্যাকআর্থার পার্ক থেকে পাওয়া এই আতঙ্কজাগানিয়া চিত্র আমেরিকান জনগণের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে এসেছে। ক্রমবর্ধমান সংখ্যক মানুষ—এমনকি অনেক রিপাবলিকান ভোটারও এখন দেখতে পাচ্ছেন যে ট্রাম্পের অভিযান আকারে যেমন বিশাল, তেমনি আগ্রাসী ও ব্যয়বহুল, অথচ বাস্তবে খুব একটা নির্বাসন ঘটছে না। অন্যদিকে, নিয়মিত সংবাদমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে স্কুলের পার্কিংয়ে দাঁড়িয়ে মুখোশধারী আইসিই এজেন্ট প্রস্রাব করছে, কিংবা বেআইনিভাবে মার্কিন নাগরিকদের আটকে রাখছে।
মে মাসের আগেও বেশিরভাগ আমেরিকান আইসিই সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা রাখতেন। এখন এই সংস্থা মনে করিয়ে দেয় কালো গাড়ি, মুখোশধারীদের দল এবং ‘অলিগেটর আলকাট্রাজ’-এর দৃশ্য। এজেন্টরা নিজেদের পরিচয় দিতে অস্বীকৃতি জানায়, আর মাগা আন্দোলন সেটাকে উৎসাহিত করে। এর ফলে বহু আমেরিকানের চোখে আইসিই এখন ট্রাম্পের ‘ব্যক্তিগত গুন্ডা বাহিনী’। এখন ৫৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মনে করেন আইসিই অনেক দূর চলে গেছে।
মানুষ জানে ঠিক কার কারণে আইসিই এইভাবে লাগামহীন হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক ছয়টি জনমত জরিপে দেখা গেছে, ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির জনপ্রিয়তা ভেঙে পড়েছে। রিপাবলিকানদের ঐতিহ্যগত শক্তিশালী ইস্যুতে এখন ভোটারদের মধ্যে তারা তিন পয়েন্ট পিছিয়ে। এমন জনপ্রিয়তা পতন সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল ২০০৬ সালে, যখন ডেমোক্র্যাটরা এটি কাজে লাগিয়ে কংগ্রেসের উভয় কক্ষ দখল করে নেয়। ট্রাম্পের এই ভুল পদক্ষেপ যেন সেই ইতিহাসই পুনরাবৃত্তির পথে নিয়ে যাচ্ছে।

সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্রের মতন পুলিশ-রাষ্ট্র কৌশলের প্রতি ট্রাম্পের যে ঝোঁক, তা আমেরিকার সমস্ত রাজনৈতিক শ্রেণির নাগরিকদের মধ্যে এক তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে। এমনকি যারা আগে ট্রাম্পের মিত্র ছিলেন, যেমন রক্ষণশীল ক্যাথলিক বিশপরাও এখন বিস্মিত। তারা বুঝে গেছেন, ট্রাম্পের 'খুনিদের আর ধর্ষকদের' ফেরত পাঠানোর প্রতিশ্রুতি ছিল একটা মিথ্যা।
জুন ২৯-এ নিউইয়র্ক টাইমসকে ক্যার্ডিনাল রবার্ট ম্যাকএলরয় বলেন, 'বেশিরভাগই পরিশ্রমী, সৎ মানুষদের দেশ থেকে বের করে দেওয়ার পদক্ষেপে বহু বিশপ এবং ধর্মীয় নেতারা রীতিমতো ক্ষুব্ধ। বাস্তবতা দিন দিন আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে।'
অন্য রক্ষণশীলরাও উদ্বেগ প্রকাশ করছেন যে এসব অভিযানে বহু নিরপরাধ মানুষও ধরপাকড়ের শিকার হচ্ছেন। ‘আর স্ট্রিট ইনস্টিটিউট’-এর স্টিভেন গ্রিনহাট ‘অরেঞ্জ কাউন্টি রেজিস্টার’-এ এক প্রবন্ধে লিখেছেন, 'আইসিই-এর গ্রেপ্তারের ভুল মাত্রা সংবিধানসম্মত শাসনের প্রতি আগ্রহী যেকোনো মানুষের জন্য গভীরভাবে উদ্বেগজনক।'
গ্রিনহাট সঠিক বলেছেন: বর্তমান মাগা প্রভাবিত রূপে আইসিই হয়ে উঠেছে আমেরিকার নাগরিক স্বাধীনতার এক তীব্র হুমকি। রিপাবলিকানরা সেই হুমকিকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে, যখন তারা ব্যাখ্যাহীনভাবে আইসিই-কে ট্রাম্পের 'ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল'-এর আওতায় ৭৫ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেয়। রক্ষণশীল ভাষ্যকার চার্লি কার্ক ৩ জুলাই গর্ব করে বলেন, এই অর্থ আইসিই-কে 'একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী'তে পরিণত করেছে, যা 'আদালতের ধরাছোঁয়ার বাইরে'।
এখন আইসিই যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি অর্থায়নপ্রাপ্ত আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, যার বাজেট পুরো কানাডার সামরিক বাজেটের সমান। লক্ষ লক্ষ আমেরিকান দেখছে, কীভাবে এই সংস্থাটি জবাবদিহিহীন হয়ে উঠেছে শিশুদের সামার ক্যাম্পে সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে হামলা চালাতেও তারা দ্বিধা করে না। মানুষ এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, উদ্দেশ্য যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক, এমন নিষ্ঠুর উপায় কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এটা সেই অভিবাসন সংস্কার নয়, যা ভোটারদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যেখানে ‘গ্যাং সদস্য’ আর ‘কঠোর অপরাধী’দের লক্ষ্য করার কথা ছিল। বরং তারা এখন দেখছে, বড় বড় শহরের রাস্তায় সামরিক বাহিনী ও যুদ্ধযান যেন নিত্যদিনের দৃশ্য হয়ে উঠেছে। মুখোশধারী আইসিই এজেন্টদের দেখে সাধারণ মানুষ এখন আগের চেয়ে কম নিরাপদ বোধ করছে। এবং তারা একের পর এক জনমত জরিপে জানিয়ে যাচ্ছে তারা আর এই ভুল করতে চায় না।
যেসব ভোটার ট্রাম্পের অভিবাসন সম্পর্কিত প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে প্রতারিত বোধ করছেন, তাদের এই প্রতিবাদ-প্রবৃত্তিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সোমবার ম্যাকআর্থার পার্কে আমরা যা দেখেছি, তা কখনোই স্বাভাবিক হয়ে উঠতে দেওয়া যাবে না। এখনই সময় আমেরিকার জনগণ যেন তাদের বিবেককে রাজনৈতিক কর্মে পরিণত করে এবং দাবি তোলে আইসিই-এর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যদি রিপাবলিকানরা তা না শোনে, তবে ২০২৬ সালের ব্যালট বাক্সে তারা ভোটারদের ক্ষোভের স্পষ্ট বার্তা পাবে।
ছাবেদ সাথী: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক এবং মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[বাংলা প্রেস বিশ্বব্যাপী মুক্তচিন্তার একটি সংবাদমাধ্যম। স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের জন্য নিরপেক্ষ খবর, বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজ আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।] বিপি।এসএমআপনি এগুলোও পছন্দ করতে পারেন





