
সাংবাদিক বিভুরঞ্জনের মৃত্যু: 'আমার দুইখান কথা আছে'


ছাবেদ সাথী
বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজ আজ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে স্মরণ করছে বিভুরঞ্জন সরকারকে। তাঁর আকস্মিক ও মর্মান্তিক মৃত্যু শুধু একটি ব্যক্তিগত শূন্যতা নয়, বরং আমাদের সাংবাদিকতার জন্য এক বিশাল ক্ষতি। তিনি ছিলেন সেই মানুষ, যিনি পেশাকে শুধু জীবিকা হিসেবে নেননি—নিয়েছিলেন দায় ও দায়িত্ব হিসেবে।
বিভুরঞ্জন সরকারের সাংবাদিকতা ছিল সত্যভিত্তিক, ন্যায়ভিত্তিক। তিনি বিশ্বাস করতেন, সংবাদ শুধু তথ্য নয়; এটি সমাজকে আলোকিত করার এক মহৎ মাধ্যম। তিনি কখনও চটকদার শিরোনামের পেছনে ছুটে যাননি, বরং পাঠককে সত্যের সন্ধান দিতে কলম চালিয়েছেন। এমন মানুষ আজ বড়ই বিরল।
কিন্তু তাঁর মৃত্যু আমাদের সামনে কিছু কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে। সাংবাদিকতার এই কঠিন বাস্তবতায় আমরা কি আমাদের সহকর্মীদের যথেষ্ট সম্মান, নিরাপত্তা, ভালোবাসা দিতে পেরেছি? যে মানুষ সারাজীবন সমাজকে আলোকিত করেছেন, তাঁর নিজের জীবন কেন এত নিঃসঙ্গতায়, অবহেলায় আচ্ছন্ন হলো?
সিনিয়র সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের আকস্মিক ও মর্মান্তিক মৃত্যু শুধু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, বরং আমাদের সাংবাদিকতার বর্তমান অবস্থা, তার দুর্বলতা ও অনৈতিকতার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। তাঁর প্রয়াণ আমাদের মনে করিয়ে দিল যে, এ পেশায় দীর্ঘদিন অবহেলা, চাপ ও অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে টিকে থাকতে হয়, যার মূল্য অনেক সময় প্রাণ দিয়েই চুকাতে হয়।
বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ইতিহাস গৌরবমণ্ডিত হলেও সাম্প্রতিক দশকে তা নৈতিকতার সংকটে নিমজ্জিত। সংবাদ সংগ্রহে অগভীরতা, যাচাই-বাছাইয়ের অভাব, দলীয় আনুগত্য, আর্থিক টানাপোড়েন এবং পেশাগত স্বাধীনতার ঘাটতি সংবাদ মাধ্যমকে দুর্বল করে তুলেছে। অনেক ক্ষেত্রেই সংবাদ পরিবেশন হচ্ছে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে। বিভুরঞ্জন সরকারের মতো অভিজ্ঞ সাংবাদিকেরা সবসময়ই চেয়েছেন সংবাদপত্রকে সত্য, বস্তুনিষ্ঠতা ও পাঠকের আস্থার জায়গায় রাখতে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে নতুন প্রজন্মের অনেক সাংবাদিক এই মৌলিক দায়িত্বকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
আমাদের দেশে সাংবাদিকতা এখন এক অনিশ্চিত জীবিকা। নিয়মিত বেতন না পাওয়া, নিরাপত্তার অভাব, চাকরি হারানোর ভয় এবং রাজনৈতিক চাপ—সব মিলিয়ে সাংবাদিকরা চরম মানসিক চাপের মধ্যে কাজ করেন। এই পেশায় আজ ‘অবসাদ’ এক ভয়াবহ বাস্তবতা। বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে সাংবাদিকেরও শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা রক্ষার জন্য পরিবেশ প্রয়োজন, যা আমরা দিতে ব্যর্থ হয়েছি।

আমরা পাঠকরাও দায় এড়াতে পারি না। হলুদ সাংবাদিকতা, চটকদার শিরোনাম, গুজব বা অর্ধসত্য—এসবের প্রতি পাঠকের এক ধরনের আকর্ষণ আছে। ফলে গণমাধ্যম ব্যবসায়ী মালিকরা পেশাদারিত্বের পরিবর্তে ক্লিক বা রেটিং বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন। সত্যের প্রতি দায়িত্বশীল না হয়ে বিনোদনকেন্দ্রিক সংবাদ পরিবেশন করা সহজ হয়ে যায়। এর ফলশ্রুতিতে একজন নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিকের কাজ মূল্যায়ন হয় না, বরং তিনি একাকী হয়ে পড়েন।
বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যুকে আমরা যদি শুধু শোকের ঘটনা হিসেবে দেখি, তবে তা হবে আমাদের ব্যর্থতা। বরং এটি হতে হবে সাংবাদিক সমাজ, মিডিয়া মালিক এবং রাষ্ট্র—সবার জন্য আত্মসমালোচনার উপলক্ষ। আমাদের ভাবতে হবে—এই পেশায় নিয়োজিত মানুষদের কীভাবে সুরক্ষা, সম্মান ও পেশাগত মর্যাদা দেওয়া যায়। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও নৈতিকতা রক্ষা না করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আর কোনো বিভুরঞ্জন সরকারকে অনুপ্রেরণা হিসেবে পাবে না।
সাংবাদিকতা কেবল একটি পেশা নয়; এটি গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ। আর এই স্তম্ভ যদি দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে রাষ্ট্র ও সমাজ উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিভুরঞ্জন সরকারের প্রয়াণ আমাদের জন্য শোকবার্তা বটে, কিন্তু একইসাথে এটি একটি সতর্কবার্তাও—আমাদের সাংবাদিকতার বর্তমান সংকটকে সমাধান করতে না পারলে সামনে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে। এখন সময় এসেছে সাংবাদিকতা পুনর্গঠনের, পেশাদারিত্ব ও নৈতিকতার আলো ফেরানোর।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতার আজ যে অবক্ষয়—হলুদ সাংবাদিকতা, গুজব, অর্ধসত্য প্রচার, রাজনৈতিক আনুগত্য - সবকিছুই আমাদের বিভুরঞ্জনের মতো সৎ ও নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিককে আরও একা করে তুলেছিল। তাঁর মৃত্যু তাই কেবল শোকের নয়, এটি আমাদের জন্য আত্মসমালোচনারও মুহূর্ত।
আজ আমরা তাঁকে বিদায় জানাচ্ছি গভীর শ্রদ্ধায়। তাঁর কলম হয়তো আর লিখবে না, কিন্তু তাঁর সততা, নৈতিকতা, এবং সত্যের প্রতি অটল নিষ্ঠা আমাদের পথ দেখাবে। সাংবাদিকতার অন্ধকার সময়ে বিভুরঞ্জন সরকার ছিলেন এক আলোকবর্তিকা। সেই আলো নিভে গেলেও, তার উজ্জ্বলতা আমাদের স্মৃতিতে চিরকাল বেঁচে থাকবে।
শেষ কথা
বিভুরঞ্জন সরকারকে হারানো মানে কেবল একজন সাংবাদিককে হারানো নয়; বরং একজন সত্যসন্ধানী মানুষকে হারানো। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো মানে এই প্রতিজ্ঞা করা—আমরা সাংবাদিকতার সততা, নৈতিকতা ও মানবিকতার মানদণ্ড অক্ষুণ্ণ রাখব।
শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও অশ্রুভেজা বিদায়—
বিভুরঞ্জন সরকার, আপনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন।
ছাবেদ সাথী: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক ও মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সম্পাদক বাংলা প্রেস [বাংলা প্রেস হলো মুক্ত চিন্তার একটি বৈশ্বিক প্রচার মাধ্যম। এটি স্বাধীনচেতা মানুষের জন্য নিরপেক্ষ সংবাদ, বিশ্লেষণ ও মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজকের দিনে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।] বিপি। সিএসআপনি এগুলোও পছন্দ করতে পারেন





