ছাবেদ সাথী
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তনের পর পুরোনো এক পরিচিত ঘরানার লেখা আবার ফিরে এসেছে — বিদেশ ভ্রমণের সময় আমেরিকান হিসেবে 'লজ্জা' পাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে দুঃখপ্রকাশ।
সম্প্রতি ইউএসএ টুডে একটি শিরোনামে ছেপেছে: "আমি তাকে ভোট দেইনি’: বিদেশে আমেরিকান পর্যটকরা বিশ্বব্যাপী দৃষ্টিভঙ্গির মুখে কীভাবে সামলাচ্ছেন।" সেখানে একটি দম্পতির গল্প বলা হয়েছে যারা ট্রাম্প সমর্থক মনে করা হতে পারে এমন আশঙ্কায় তাদের বিদেশ সফরই বাতিল করে দেন। বিবিসি লিখেছে, 'মানুষ হয়তো আমাদের ভিন্নভাবে দেখবে: ট্রাম্প যুগে প্যারিসে আমেরিকান পর্যটকদের লজ্জা অনুভব।' বোস্টন গ্লোবের এক কলাম লেখক লিখেছেন: 'ট্রাম্পের আচরণ আমাকে আমেরিকান হিসেবে লজ্জিত করে তোলে।'
এক সমীক্ষা বলছে, ৭২ শতাংশ 'অভিজ্ঞ' মার্কিন ভ্রমণকারী আশঙ্কা করেন যে তারা বিদেশে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারেন।
এই সব লেখার অন্তর্নিহিত ধারণা হলো: ট্রাম্পের প্রতি বিদেশিদের বিরাগ পুরো আমেরিকান পরিচয়কেই কলুষিত করেছে। কিন্তু এই দুশ্চিন্তা আসলে যারা এটি করছেন-সাধারণত প্রগতিশীল, পশ্চিমা অভিজাত শ্রেণি- তাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, বাস্তবে আমেরিকানরা বিদেশে ঠিক কীভাবে গৃহীত হচ্ছেন, তার নয়।
এটি গণমাধ্যমের বয়ান কীভাবে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলে, সেটাও দেখায়। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ বিদেশে অস্বাগত বোধ করার ভয় পায়-কারণ মিডিয়া বারবার বলছে, তারা হয়তো অবাঞ্ছিতই।
ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর আমি গ্রিনল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইংল্যান্ড, পানামা ও মেক্সিকো-এই পাঁচটি দেশেই দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি। কোথাও শত্রুতার মুখোমুখি হইনি। রিপাবলিকান বা ডেমোক্রেট যেই হোন না কেন, বহু দেশের বহু ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বিদেশে আমেরিকান হিসেবে ভয় পাওয়ার এই প্রবণতা অতিরঞ্জিত- এটা মূলত দেশের রাজনীতির চাপের বহিঃপ্রকাশ, বৈশ্বিক বাস্তবতার প্রতিফলন নয়।
হ্যাঁ, বিদেশিরা ট্রাম্পকে চেনে। হ্যাঁ, তাদের মতামতও আছে-যেমন আমাদেরও থাকে। কিন্তু ধারণাটা যে, ট্রাম্পের কারণে আমেরিকানরা প্রতিনিয়ত ঘৃণিত বা উপেক্ষিত হচ্ছে, সেটি আমাদের ঘরোয়া রাজনীতির গোঁড়ামি থেকে জন্ম নেওয়া কল্পনা। বাস্তবে দেখা যায়, অধিকাংশ বিদেশিই আমেরিকানদের সাদরে গ্রহণ করে। আর কখনো গ্রহণ না করলেও সেটা সাধারণত রাজনীতির জন্য নয়-বরং সংস্কৃতিগত অজ্ঞতা, বিপুলসংখ্যক পর্যটকের চাপ, কিংবা ধনী ভ্রমণকারীদের আবাসন বাজারে প্রভাবের মতো কারণেই হয়।
নিশ্চয়ই কেউ কেউ ট্রাম্পকে অপছন্দ করে এবং সেই অনুযায়ী আমেরিকানদেরও বিচার করে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তাদের নিজের দেশ, সমস্যা, রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত। তারা বোঝে, একজন প্রেসিডেন্ট মানেই পুরো দেশের প্রতিনিধিত্ব নয়। ট্রাম্প যেমন বিশ্বজুড়ে পরিচিত, তেমনি লেব্রন জেমস বা টেইলর সুইফটও-পরিচিতি মানেই সম্মান বা ঘৃণা নয়।
গোটা জনসংখ্যার হিসাবে, মাত্র ২৩ শতাংশ আমেরিকান ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে। অর্থাৎ যাকে আপনি বিদেশে দেখছেন, তিনি ট্রাম্প-বিরোধী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
এছাড়া, অনেক বিদেশিই ট্রাম্পকে নিয়ে জটিল এবং মিশ্র অনুভূতি পোষণ করেন। যেমন গ্রিনল্যান্ডে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছিলাম যিনি ২০১৬-তে ট্রাম্প জয়ী হওয়ায় আতঙ্কিত হয়েছিলেন। কিন্তু যখন তিনি ট্রাম্পের কিম জং উনের সঙ্গে অপ্রত্যাশিত সৌহার্দপূর্ণ সম্মেলন দেখেন, তখন তার মত বদলে যায়।
তিনি বলেছিলেন, 'শুধু দেখবেন না ট্রাম্প কোথায় বল মারছেন-সেটা কয়েকবার গিয়ে লেগে পরে পকেটে পড়তে পারে।' এই ধরনের পরিমিত দৃষ্টিভঙ্গিই বিদেশে বহু মানুষের মধ্যে দেখা যায়, যা অনেক মার্কিন সংবাদপত্রে অনুপস্থিত।
গ্রিনল্যান্ডে এমনও দেখেছি, কেউ কেউ ট্রাম্পকে ঘৃণা করে, কেউ কেউ তাকে সত্যিই পছন্দ করে। 'গ্রিনল্যান্ড কিনে নেওয়া' নিয়ে ট্রাম্পের বক্তব্য কেউ কেউ মজার ছলে নিয়েছেন-অন্তত তাদের দেশকে বিশ্বমানচিত্রে এনেছেন, এমন স্বীকারোক্তি দিয়েছেন হাসিমুখে।
হ্যানয়-তে এক নারী বলেছিলেন, তিনি ট্রাম্পের বিরোধীদের নিয়ে ভিন্ন পন্থা নেওয়াকে শুরুতে ইতিবাচক হিসেবে দেখেছিলেন, কিন্তু ট্রাম্পের আরোপিত শুল্কের কারণে এখন তিনি অনেকটা সন্দিহান। এই দৃষ্টিভঙ্গি অন্ধ সমর্থন নয়, আবার একেবারে প্রত্যাখ্যানও নয়-বরং একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান, যা বহু রিপোর্টার আমেরিকানদের মধ্যেও দেখতে পান না।
আর অনেক সময়ই প্রতিক্রিয়া হয় সম্পূর্ণ উদাসীনতা। পেরুর লিমায় এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ট্রাম্প ভোটারদের নিয়ে কী ভাবেন, তিনি বলেছিলেন: 'আমি ভাবি না।' যেমন আমি পেরুতে গিয়ে তাদের রাষ্ট্রপতির নাম জানতাম না-সেভাবেই তারও আমাদের নিয়ে ভাবার কারণ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিশাল হলেও, পৃথিবী আমাদের নিয়েই বেঁচে থাকে-এমন ভাবা নিছক আত্মকেন্দ্রিকতা।
অনেক লিবারেলই দেশ ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাম্পের নিন্দা জানানোর প্রয়োজন অনুভব করেন। আমি কখনো করিনি-ঠিক যেমন আমি ওবামা থাকাকালে বিশ্বে প্রশংসিত বলেই নিজের কৃতিত্ব মনে করিনি। বাইরের জয় যেমন আমার নয়, তেমনি বাইরের লজ্জাও নয়।
যারা ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন বিদেশ ভ্রমণে দ্বিধা বোধ করেন, তাদের বলব: টক শো বা শিরোনাম দেখে ভুলে যাবেন না যে, একটি মার্কিন পাসপোর্ট বিশাল এক সুযোগ-প্রায় প্রতিটি সীমান্ত আপনাকে স্বাগত জানায়, প্রায়শই ভিসাবিহীন।
হ্যাঁ, আমেরিকান হওয়ার কারণে কোথাও কোথাও আপনি লক্ষ্যবস্তু হতে পারেন। কিন্তু অধিকাংশ সময় আপনি পাবেন সম্মান, কৌতূহল ও সদয় ব্যবহার। মানুষ আপনার দেশের রাজনীতির তুলনায় আপনার আচরণ বেশি গুরুত্ব দেয়।
তাই, প্রিয় আমেরিকান বন্ধুরা-পাসপোর্টটি গর্বের সঙ্গে ব্যবহার করুন। আমেরিকার সেরা মূল্যবোধ-উন্মুক্ততা, উদারতা ও শেখার আগ্রহ-এগুলোর দূত হন। মানুষ ট্রাম্পকে নয়, আপনাকেই মনে রাখবে।
ছাবেদ সাথী: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক-সাংবাদিক। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সম্পাদক বাংলা প্রেস।
[বাংলা প্রেস বিশ্বব্যাপী মুক্তচিন্তার একটি সংবাদমাধ্যম। স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের জন্য নিরপেক্ষ খবর, বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজ আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]
বিপি।এসএম
[বাংলা প্রেস হলো মুক্ত চিন্তার একটি বৈশ্বিক প্রচার মাধ্যম। এটি স্বাধীনচেতা মানুষের জন্য নিরপেক্ষ সংবাদ, বিশ্লেষণ ও মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজকের দিনে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]