ছাবেদ সাথী
যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সচিব ক্রিস্টি নোয়েম সম্প্রতি কংগ্রেসে এক শুনানিতে হ্যাবিয়াস করপাস আইনের ভুল ব্যাখ্যা দেন-এটি উদ্বেগজনকভাবে ইঙ্গিত দেয় যে, শীর্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও হয়তো আইনের শাসন এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন না কিংবা তা সম্মান করার ইচ্ছা নেই।
নোয়েম এমন একটি সংস্থা তত্ত্বাবধান করেন-ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই)—যা এরই মধ্যে মার্কিন রাস্তাঘাট থেকে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী, অভিবাসনপত্রবিহীন অভিবাসী এবং স্থায়ী বাসিন্দাদের 'বলপূর্বক গুম' করছে। আইসিই কর্মকর্তারা প্রায়ই মুখোশ পরে থাকেন, যা তাদের বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার, 'নক অ্যান্ড অ্যারেস্ট', এমনকি গাড়ির জানালা ভেঙে ফেলার মতো কাজ থেকে জবাবদিহির বাইরে রাখে।
অবশ্য বাস্তবে আইসিই তুলনামূলকভাবে কম নজরদারির আওতায় থাকলেও আইনত তারা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারের জবাবদিহির আওতায়, এবং একাধিক বেসামরিক মামলার মুখোমুখিও হয়েছে।
আইসিই ভাঙাচোরা এক প্রতিষ্ঠান—তবে সামনে যে ঝুঁকি দেখা দিচ্ছে, তা আরও ভয়াবহ।
গত কয়েক মাস ধরে, প্রাক্তন প্রাইভেট মিলিটারি কোম্পানি ব্ল্যাকওয়াটারের প্রধান এরিক প্রিন্স হোয়াইট হাউসে একাধিক প্রস্তাব দিয়েছেন ব্যাপক মাত্রায় অভিবাসী বহিষ্কারের কাজ এগিয়ে নিতে। প্রিন্সের যুক্তি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কঠোর বহিষ্কারের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে সরকারকে আইসিই’র ক্ষমতার বাইরে গিয়ে "সম্পূরক ব্যবস্থা" নিতে হবে। তার একটি প্রস্তাব অনুসারে, তার নতুন কোম্পানি ‘২ইউএসভি’ প্রশিক্ষণ দিয়ে ১ লাখ পর্যন্ত সশস্ত্র, 'ডেপুটাইজড' নাগরিক মোতায়েন করতে চায়।
এই পরিকল্পনা এখনো অনুমোদিত না হলেও, ট্রাম্প বলেছেন, 'প্রয়োজনে আমি এটাতে আপত্তি করব না'।
অভিবাসন এবং সশস্ত্র অ-রাষ্ট্রীয় গোষ্ঠী নিয়ে গবেষণা করা একাডেমিকদের দৃষ্টিতে, এই ধরনের পরিকল্পনা গভীরভাবে উদ্বেগজনক। গবেষণায় দেখা গেছে, এমন তিনটি বৈশিষ্ট্য এই ধরনের বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট:
১. সরকার তাদের ব্যবহার করে রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য মানবাধিকার লঙ্ঘন।
২. দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন বাহিনী গঠনের জন্য অনুকূল।
৩. সরকার এই বাহিনীর ব্যবহার করে আইনবহির্ভূত কাজের দায় এড়াতে পারে।
প্রিন্স যে বাহিনী গঠনের কথা বলছেন, তা এক প্রকার 'সরকারঘনিষ্ঠ মিলিশিয়া'-একটি সংগঠিত, সশস্ত্র গোষ্ঠী যা সরকার-সমর্থিত কিন্তু আনুষ্ঠানিক নিরাপত্তা বাহিনীর অংশ নয়।
এমন বাহিনীকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে দূরে রাখা যায়—এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সরকারগুলো প্রায়ই 'কৌশলগত সহিংসতা'-র দায় এড়িয়ে যায়। আন্তর্জাতিক চাপ কিংবা গণতান্ত্রিক জবাবদিহির মুখে পড়লে সরকার দোষ চাপিয়ে দেয় এমন বাহিনীর ওপর। ফলে এসব দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি মারাত্মকভাবে অবনতি ঘটে—যেমনটা আমরা দেখেছি সার্বিয়া, আর্জেন্টিনা এবং চিলিতে।
সার্বিয়ার জাতীয়তাবাদী বাহিনী ‘টাইগারস’ ১৯৯০-এর দশকে বসনিয়া ও ক্রোয়েশিয়ায় ব্যাপক যুদ্ধাপরাধ করে, কিন্তু সার্বিয়ান নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা দায়মুক্তি পেয়েছিলেন, কারণ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল প্রমাণ করতে পারেনি যে তারা সরাসরি অপরাধ পরিকল্পনা বা সংগঠনে যুক্ত ছিলেন।
এছাড়া, ১৯৭০-এর দশকে আর্জেন্টিনার ‘অপারেশন কনডর’ বা চিলিতে ১৯৭৩ সালের অভ্যুত্থানে এই ধরনের মিলিশিয়া বাহিনী গোপনে অপহরণ, হত্যা ও নির্যাতন চালিয়েছিল—সরকার নিজেদের "পরিচ্ছন্ন" রাখতে তাদের ব্যবহার করেছিল।
অনেকেই মনে করেন, এমন প্যারামিলিটারি বাহিনী কেবল একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দেখা যায়, কিন্তু গবেষণা বলছে, এগুলো বেশি গড়ে ওঠে "দুর্বল গণতন্ত্রে", যেখানে নির্বাহী শাখার ওপর জবাবদিহি দুর্বল এবং প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো ভঙ্গুর। শক্তিশালী গণতন্ত্রে এসব ঠেকাতে আইনগত বাধা থাকে।
কিন্তু ট্রাম্পের প্রশাসন আমলে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও স্বাধীন মিডিয়ার ওপর ধারাবাহিক আক্রমণে এই বাধাগুলো ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে।
রাজনৈতিক পণ্ডিতদের 'পলিটি স্কোর' অনুসারে, যা -১০ (উ. কোরিয়া) থেকে +১০ (সুইডেন)-এর মধ্যে গণতন্ত্রের মাত্রা নির্দেশ করে, যুক্তরাষ্ট্রের স্কোর ২০২০ সালে নেমে আসে ৫-এ—যা "দুর্বল গণতন্ত্র"-এর শ্রেণিভুক্ত।
এর অর্থ কি? এর অর্থ, যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন প্রয়োগে সন্দেহজনক বেসরকারি বাহিনীর ব্যবহার এখন কেবল সম্ভাব্য নয়, বাস্তবসম্মত। এদের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকি প্রকট। ব্ল্যাকওয়াটার, প্রিন্সের পূর্বতন কোম্পানি, অতীতে ইরাকে অন্তত ১৪ বেসামরিককে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিল—আর এই অপরাধীদের ২০২০ সালে ট্রাম্প ক্ষমা করে দেন।
এদিকে, আদালতের বিলম্ব এড়িয়ে দ্রুত বহিষ্কার করতে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অনেক সময় সরাসরি আদালতের আদেশ উপেক্ষা করছে। সম্প্রতি দক্ষিণ সুদানে অভিবাসীদের এক বিতাড়ন তার প্রমাণ। সাবেক আইসিই প্রধান টম হোম্যান বলেছিলেন, 'আমি বিচারকদের ভাবনা নিয়ে ভাবি না।'
অনেকে বলতেই পারেন, যুক্তরাষ্ট্র ভিন্ন, এখানে এমন কিছু ঘটতে পারে না—সংবাদমাধ্যম ও আদালত সব কিছুর জবাবদিহি নিশ্চিত করবে।
কিন্তু গণতান্ত্রিক কাঠামো স্পষ্টভাবে ভেঙে পড়ছে। সংবাদমাধ্যমে মানুষের আস্থা ঐতিহাসিকভাবে সর্বনিম্ন। এই পরিস্থিতিতে এমন বাহিনী ব্যবহারের মতো আগ্রাসী পদক্ষেপ যে শুধু অভিবাসীদের জন্যই বিপজ্জনক হবে না, তা স্পষ্ট।
এই বাস্তবতায় জবাবদিহিমূলক যন্ত্রগুলো যতদিন টিকে আছে, ততদিনই এই ধরনের পরিকল্পনা প্রতিরোধ করা জরুরি।
ছাবেদ সাথী: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন নীতি পর্যবেক্ষক। সম্পাদক বাংলা প্রেস।
[বাংলা প্রেস হলো মুক্ত চিন্তার একটি বৈশ্বিক প্রচার মাধ্যম। এটি স্বাধীনচেতা মানুষের জন্য নিরপেক্ষ সংবাদ, বিশ্লেষণ ও মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজকের দিনে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]