১৩ অক্টোবর ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব: এখনও কি এর যৌক্তিকতা আছে?

Logo
বাংলা প্রেস প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৪২ পিএম
যুক্তরাষ্ট্রে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব: এখনও কি এর যৌক্তিকতা আছে?
    ছাবেদ সাথী ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি, পুনর্নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব প্রথা বাতিল করে একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেন। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের সাংবিধানিক এক নীতির ভবিষ্যৎ এখন আইনি ও রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে চলে এসেছে। আদেশ অনুযায়ী, ঘোষণার ৩০ দিনের বেশি সময় পর জন্ম নেওয়া সেইসব শিশুরা আর নাগরিকত্ব পাবে না, যাদের মাতা অননুমোদিত অভিবাসী এবং পিতা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক বা বৈধ স্থায়ী বাসিন্দা নন; কিংবা মায়ের অভিবাসন বৈধ হলেও তা শুধুমাত্র অস্থায়ী, এবং পিতাও নাগরিক নন। এই আদেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জেলা আদালতে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে, যেগুলোর দাবি এটি সংবিধানবিরোধী। তিনটি জেলা আদালত এই আদেশের বিরুদ্ধে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যাতে মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ট্রাম্পের এই নির্দেশ কার্যকর না হয়। এই নিষেধাজ্ঞাগুলো শুধু মামলার বাদীদের জন্য নয়, বরং সারা দেশের জন্য প্রযোজ্য ছিল। পরে সুপ্রিম কোর্ট ট্রাম্প প্রশাসনের আবেদনে আংশিকভাবে নিষেধাজ্ঞাগুলো স্থগিত করে দেয়। তবে এই স্থগিতাদেশ কেবল সেই পরিমাণে কার্যকর ছিল, যা প্রত্যেক বৈধ বাদীকে পূর্ণ সুরক্ষা দিতে প্রয়োজন। আদালত তখনো আদেশটির ১৪তম সংশোধনী লঙ্ঘন করছে কি না, সেই প্রশ্নে চূড়ান্ত মত দেয়নি; বরং এই সিদ্ধান্ত জেলা আদালতগুলোর উপর ছেড়ে দেয়। ভবিষ্যতে যদি সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে রায় দেয়, তারা কি এটিকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেবে? এটি নির্ভর করবে এই প্রশ্নের উপর: বিচারপতিরা সংবিধানকে কি 'একটি জীবন্ত দলিল' হিসেবে দেখেন কি না অর্থাৎ এমন একটি দলিল, যেটিকে সময়ের প্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক এবং কার্যকর রাখার জন্য অভিযোজিত হতে হয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র এখন সেই ১৪তম সংশোধনী প্রণীত হওয়ার সময়কার দেশের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বা জাস্ট সোলি (মাটি থেকে প্রাপ্ত অধিকার), বিশ্বজুড়ে খুব সাধারণ নয়। বর্তমানে পৃথিবীর ১৯৫টি দেশের মধ্যে মাত্র ৩০টি দেশে এই প্রথা আছে যা মোটের ১৫ শতাংশ মাত্র। অধিকাংশ জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব প্রদানকারী দেশই উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় অবস্থিত। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক জন স্ক্রেন্টনি মনে করেন, জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব মূলত ঔপনিবেশিক যুগে জাতিরাষ্ট্র গড়ে তুলতে চালু করা হয়েছিল। এটি ইউরোপ থেকে অভিবাসন উৎসাহিত করেছিল এবং নিশ্চিত করেছিল যে আদিবাসী ও দাসপ্রথার শিকার জনগোষ্ঠী ও তাদের সন্তানরা নাগরিকত্ব পাবে এবং রাষ্ট্রহীন থাকবে না। স্ক্রেন্টনির মতে, এটি ছিল এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এক নির্দিষ্ট কৌশল এবং সেই সময়টি হয়তো এখন শেষ হয়ে গেছে। মার্কিন সংবিধানের প্রণেতারা ‘নাগরিকত্ব’ বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করেননি। তবে ১৭৯০ সালের নাগরিকত্ব আইন-এর মাধ্যমে নাগরিকত্বের একটি সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়, যেখানে বলা হয়েছিল, শুধুমাত্র সম্পত্তির মালিকরাই নাগরিক হতে পারবেন। এর ৭৬ বছর পর, ১৮৬৬ সালে, যুক্তরাষ্ট্র নাগরিক অধিকার আইন প্রণয়ন করে, যা আফ্রিকান আমেরিকান পুরুষদের ভোটাধিকার দেয়। এর প্রথম অংশে বলা হয়: "যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী এবং কোনো বিদেশি শক্তির অধীন নয় এমন সকল ব্যক্তিই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক বলে গণ্য হবেন; এবং এই নাগরিকরা— তাদের জাতি বা পূর্ববর্তী দাসত্ব বা জবরদস্তিমূলক শ্রমের অবস্থান বিবেচনা না করে শ্বেতাঙ্গ নাগরিকদের মতো একই অধিকার উপভোগ করবেন।" এর পর ১৮৬৮ সালে গৃহীত হয় ১৪তম সংশোধনী, যার মূল লক্ষ্য ছিল ১৮৫৭ সালের সুপ্রিম কোর্টের ড্রেড স্কট বনাম স্যান্ডফোর্ড মামলার রায় বাতিল করা। ঐ মামলায় আদালত বলেছিল, 'একজন নিগ্রো, যার পূর্বপুরুষদের যুক্তরাষ্ট্রে দাস হিসেবে আনা হয়েছিল, সে কখনোই মার্কিন নাগরিক হতে পারে না।' ১৪তম সংশোধনীতে বলা হয়, 'যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী বা স্বাভাবিকীকরণের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাওয়া, এবং দেশের আইনগত এখতিয়ারের আওতাধীন সকল ব্যক্তিই যুক্তরাষ্ট্র ও নিজ নিজ রাজ্যের নাগরিক।' ব্যক্তিগতভাবে, আমার মনে হয় না দাসপ্রথা-ভুক্ত বহু বছর এখানে বসবাস করা মানুষদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়টি এবং যুক্তরাষ্ট্রে আইন লঙ্ঘন করে সদ্য আগত অননুমোদিত অভিবাসীদের সন্তানের নাগরিকত্ব প্রদানের মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য মিল আছে। সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য ১৮৯৮ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বনাম ওং কিম আর্ক মামলায় জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব নিয়ে রায় দেয়। তবে ঐ মামলায় আদালত স্পষ্ট করে যে তারা কেবল একটি নির্দিষ্ট প্রশ্নের নিষ্পত্তি করছে: 'একজন শিশু, যার পিতামাতা চীনা বংশোদ্ভূত এবং শিশুর জন্মের সময় তারা চীনের সম্রাটের প্রজা হলেও যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বাস করছিলেন, সে কি জন্মের সময় মার্কিন নাগরিক হবে কি না। ১৮১৯ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জন মার্শাল বলেছিলেন, সংবিধান 'অনাগত শতাব্দীগুলোতে টিকে থাকার জন্য রচিত এবং তাই 'মানব সভ্যতার বিভিন্ন সংকটে অভিযোজিত হতে হবে।' যদি বর্তমান সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরাও সংবিধানকে এভাবেই দেখেন, তবে তারা জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বিষয়টিকে বর্তমান বাস্তবতার আলোকে ব্যাখ্যা করবেন যেমন অননুমোদিত অভিবাসনের সংকট, যা আমাদের অভিবাসন আদালতগুলোকে চরমভাবে চাপের মুখে ফেলেছে, যেখানে মামলার শুনানির জন্য চার থেকে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হয়, কিংবা জন্ম পর্যটন-এর মতো চর্চা। জন্ম পর্যটন বলতে বোঝানো হয়, এমন সব গর্ভবতী নারী যারা পর্যটক ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে আসেন, কিন্তু তাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে যুক্তরাষ্ট্রে সন্তান প্রসব করা যাতে সেই সন্তান জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পায়। এইভাবে ভিসার উদ্দেশ্যে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তারা যে প্রবেশ ও অবস্থান করেন, তা যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ। প্রতিনিধি পরিষদের সংবিধান সংক্রান্ত উপকমিটির চেয়ারম্যান রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান চিপ রয়ের মতে, বছরে প্রায় ১ লাখ ২৪ হাজার থেকে ৩ লাখ বার এমন ঘটনা ঘটে। এই ধরনের সমস্যাগুলোর অস্তিত্ব ১৪তম সংশোধনী রচনার সময় ছিল না, এবং এগুলোর প্রেক্ষাপটেও সংশোধনীটি তখন আলোচনা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব এখন আর কেবল একটি সাংবিধানিক ব্যাখ্যার প্রশ্ন নয়, এটি দেশের অভিবাসন ব্যবস্থা, নাগরিক অধিকার এবং জাতীয় পরিচয়ের গভীর রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। যদি আদালত এই নীতির পর্যালোচনা করে, তাহলে তা শুধু ১৪তম সংশোধনী নয়, বরং সমগ্র অভিবাসন নীতিকেই পুনর্বিবেচনার দিকে নিয়ে যেতে পারে। ছাবেদ সাথী: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক এবং মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক [বাংলা প্রেস বিশ্বব্যাপী মুক্তচিন্তার একটি সংবাদমাধ্যম। স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের জন্য নিরপেক্ষ খবর, বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজ আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।] বিপি।এসএম  
[বাংলা প্রেস হলো মুক্ত চিন্তার একটি বৈশ্বিক প্রচার মাধ্যম। এটি স্বাধীনচেতা মানুষের জন্য নিরপেক্ষ সংবাদ, বিশ্লেষণ ও মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজকের দিনে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]

মন্তব্য (0)

আলোচনায় যোগ দিন

আপনার মতামত শেয়ার করতে এবং অন্যান্য পাঠকদের সাথে যুক্ত হতে দয়া করে লগইন করুন।

এখনো কোন মন্তব্য নেই

Be the first to share your thoughts on this article!