ছাবেদ সাথী
ভবিষ্যৎ ঘটনা পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন। এই সত্যটি ২৭০০ বছর আগে আবিষ্কার করেছিল ব্যাবিলোনীয়রা, যখন তারা আবহাওয়া পূর্বাভাস দেওয়ার চেষ্টা শুরু করে। সেই সময় থেকেই আমরা পূর্বাভাসকে উন্নত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি—কারণ এতে নির্ভর করে মানুষের জীবন, কৃষিকাজ, আরও অনেক কিছু।
১৮৫৯ সাল পর্যন্ত কোনো দেশ (যুক্তরাজ্য) প্রথমবারের মতো সরকারি আবহাওয়া পূর্বাভাস দেয়—নৌপরিবহণের জন্য, যেটি ছিল তাদের সামুদ্রিক সাম্রাজ্যের প্রাণসত্তা।
সহস্রাব্দব্যাপী এই পরিশীলনের পর আবহাওয়া পূর্বাভাস ঠিক কতটা সঠিক? ন্যাশনাল ওসিয়ানিক অ্যান্ড অ্যাটমস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এনওএএ) মতে, পাঁচ দিনের পূর্বাভাস প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে সঠিক হয়। দশ দিনের পূর্বাভাস বা তারও বেশি সময়ের ক্ষেত্রে সঠিকতা কমে গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় অর্ধেক।
হারিকেন কোথায় আঘাত হানবে তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এমনকি ৪৮ ঘণ্টার পূর্বাভাসেও ৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত ত্রুটির সীমা থাকে। মানুষের আচরণ আবহাওয়ার চেয়েও কম পূর্বানুমেয়। অথচ এখানেও ঝুঁকি বিশাল।
অর্থনৈতিক পূর্বাভাসে জড়িয়ে থাকে বিলিয়ন, এমনকি ট্রিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। কর্পোরেশন, শেয়ারবাজার বিনিয়োগকারী, এমনকি ফেডারেল রিজার্ভও এসব পূর্বাভাসের ওপর নির্ভর করে বড় সিদ্ধান্ত নেয়।
বার্কলির ব্যবসা বিদ্যালয়ের দুই গবেষক ১৯৬৮ সাল থেকে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব ফিলাডেলফিয়ার করা ‘সার্ভে অব প্রফেশনাল ফোরকাস্টারস’-এর উত্তর বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, পূর্বাভাসদাতারা মাত্র ২৩ শতাংশ ক্ষেত্রে সঠিক ছিলেন।
সম্প্রতি একটি উদাহরণ: অর্থনীতিবিদরা ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি ১.৩ শতাংশ বাড়বে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। বাস্তবে সেই হার হয়েছিল তার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি।
আমার এক প্রিয় বন্ধু, যিনি কয়েক দশক আগে একটি সুপরিচিত অর্থনৈতিক পূর্বাভাস প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন, একবার বলেছিলেন তাদের অফিসের অঘোষিত নীতি ছিল: 'আমরা শেষ তিনটি মন্দার মধ্যে দশটির আগাম পূর্বাভাস দিয়েছিলাম।'
নির্বাচনের পূর্বাভাস তুলনামূলকভাবে নতুন বিষয়। এটি কঠিনতর এবং বাস্তবতায় কম প্রভাব ফেলে, কারণ এই পূর্বাভাসে আসলে কোনো কিছু পাল্টায় না। তবু এটি একটি স্বতন্ত্র খাত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই জটিলতা সত্ত্বেও আশ্চর্যজনকভাবে এসব পূর্বাভাস অনেক সময় সঠিক প্রমাণিত হয়, বিশেষ করে যখন পূর্বাভাসগুলো অনেক আগেই দেওয়া হয়।
আমেরিকান পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন সম্প্রতি একটি জার্নালে নির্বাচনের আগেই প্রস্তুত করা ডজনখানেক পূর্বাভাস প্রকাশ করেছে, যেগুলো ভিন্ন ভিন্ন তথ্য এবং পদ্ধতিতে করা হয়েছিল। বেশিরভাগই জনপ্রিয় ভোটে খুব ঘনিষ্ঠ ফলাফল দেখিয়েছিল। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের সম্ভাব্য ভোটপ্রাপ্তির সর্বোচ্চ অনুমান ছিল ৫৪.৫ শতাংশ, সর্বনিম্ন ৪৫ শতাংশ—প্রথমটি অনলাইন বেটিং ডেটার ভিত্তিতে, দ্বিতীয়টি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার ওপর। আমি এধরনের পদ্ধতির বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিই। তবু অধিকাংশ পূর্বাভাস চূড়ান্ত ফলাফলের কাছাকাছি ছিল।
জনপ্রিয় ভোটে ১১ জন পূর্বাভাসদাতার মধ্যে পাঁচজন ট্রাম্পের জয় এবং ছয়জন হ্যারিসের বিজয় দেখিয়েছিলেন। ইলেকটোরাল কলেজে পাঁচজন ট্রাম্পের জয়, তিনজন ভুলভাবে হ্যারিসের জয়ের পূর্বাভাস দেন।
যা প্রত্যাশিত, অর্থনীতি, দলীয় আনুগত্য ও প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তা ভিত্তিক ‘ফান্ডামেন্টাল’ মডেলগুলো সবচেয়ে নির্ভুল ছিল। যেমন, রে ফেয়ারের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস মডেল (যেটি এই জার্নালে ছিল না), কঠিন অর্থনৈতিক সূচকের ভিত্তিতে করা, আসল ফলাফলের মাত্র এক চতুর্থাংশ পয়েন্টের ভেতরে ছিল।
চার্লস টিয়ান ও মাইকেল লুইস-বেক প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তা এবং ছোট আকারের অর্থনৈতিক ভেরিয়েবল নিয়ে তাদের মডেল তৈরি করেছিলেন, যেটিও এক পয়েন্টের কম ত্রুটিসীমায় ছিল।
জনমত জরিপভিত্তিক মডেলগুলো তুলনামূলকভাবে কিছুটা দূরে ছিল।
আমি আগেও পরিসংখ্যানবিদ জর্জ বক্সের উক্তি উদ্ধৃত করেছি: 'সব মডেলই ভুল, কিন্তু কিছু কিছু মডেল উপযোগী।' মডেল মানেই জগতের অতিসরলীকরণ। পুরোপুরি সঠিক হতে গেলে মডেলকে জগতের মতোই জটিল, বিশৃঙ্খল ও বহুমাত্রিক হতে হতো।
তবু এই সরলীকরণ আমাদের কিছু ‘কারণ’ বুঝতে সাহায্য করে—এই নির্বাচনের এবং অন্য নির্বাচনগুলোর।
উদাহরণস্বরূপ, প্রচলিত ধারণা বলে নির্বাচন ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে হয়, কিন্তু সঠিক মডেলগুলো প্রায়শই অতীত তথ্য ব্যবহার করে, ভবিষ্যতের প্রত্যাশা নয়।
এই মডেলগুলোর কোনোটিতেই প্রার্থীদের ব্যক্তিত্ব, দক্ষতা বা ইস্যুতে অবস্থানের তথ্য নেই। অর্থাৎ, ২০২৪ সালের নির্বাচন হাড্ডাহাড্ডি হওয়ারই কথা ছিল, এবং কোনো ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর জন্য এটি জেতা ছিল কঠিন। পরিস্থিতি ছিল প্রতিকূল, এবং কারও কাছে ম্যাজিক কোনো কৌশল ছিল না যেটি দিয়ে তারা আশাতীত ফল করতে পারতেন। ব্যতিক্রমী প্রার্থী ও ব্যতিক্রমী প্রচারণা হয়তো এই বাধা পেরোতে পারত, কিন্তু সেটাই হতো ব্যতিক্রম—অসাধ্য সাধন।
অন্য কোনো প্রার্থী বা প্রাইমারিতে পরীক্ষিত কেউ কি ভালো করতেন? জানার উপায় নেই। তবে এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, হ্যারিস এমন এক দৌড় হেরেছেন যা তাঁর সহজেই জেতার কথা ছিল।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বাইডেন ভালো করতেন, না খারাপ—তাও আমরা জানি না, যদিও একজন মডেল নির্মাতা বলেছেন, বাইডেন হ্যারিসের চেয়েও সামান্য খারাপ করতেন।
কার্ল মার্কসকে এখন আর কেউ খুব একটা উদ্ধৃত করে না, কিন্তু তিনি সঠিক বলেছিলেন: “মানুষ ইতিহাস সৃষ্টি করে, তবে তাদের নিজের পছন্দের পরিস্থিতিতে নয়।”
মানসিকতা থেকে আমরা জানি, মানুষ ব্যক্তিগত গুণাবলিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়, আর পরিস্থিতির ভূমিকা কম করে দেখে।
এই মডেলগুলো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—পরিস্থিতিই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব রাখে, এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের এই নতুন পূর্বাভাসবিদ্যা অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম।
ছাবেদ সাথী: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক-সাংবাদিক, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সম্পাদক বাংলা প্রেস।
[বাংলা প্রেস বিশ্বব্যাপী মুক্তচিন্তার একটি সংবাদমাধ্যম। স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের জন্য নিরপেক্ষ খবর, বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজ আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]
বিপি।এসএম
[বাংলা প্রেস হলো মুক্ত চিন্তার একটি বৈশ্বিক প্রচার মাধ্যম। এটি স্বাধীনচেতা মানুষের জন্য নিরপেক্ষ সংবাদ, বিশ্লেষণ ও মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজকের দিনে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]